শিক্ষক দিবসের ভাবনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ভালো মানুষ তৈরি করতে চাই
দুলাল চন্দ্র বিশ্বাস
আমরা বলি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ঐতিহ্য আছে, যেটা ড. জোহার মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠেছে, যিনি নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে শিক্ষার্থীদের জীবন রক্ষা করেছিলেন। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষককে যে অন্যায়ভাবে জেলে নেওয়া হলো, এটাও একটা ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আমাদের জেলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তবুদ্ধি চর্চা বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। শিক্ষক দিবসে শুধু এরকম ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করলেই হবে না, প্রকৃতপক্ষে ছাত্রদের শেখানোর যে জায়গাটি, চিন্তা করতে শেখানো, নতুন জীবনদৃষ্টি দেওয়ার, নিজের পারিপার্শ্বিকতাকে বুঝতে শেখানো- এগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র টেক্সট বই আমরা পড়ালাম, নোট দিলাম, লেকচার দিলাম এগুলো নয়, প্রকৃতপক্ষে একজন ছাত্রের কাছে তার পারিপার্শ্বিক বাস্তবতাকে বুঝতে পারা, তার জীবনকে বুঝতে পারা, সমসাময়িককালে জীবনের, দেশের, জাতির, রাষ্ট্রের যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে সেগুলো বুঝতে পারা এবং সেই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য নিজেকে নিবেদিত করতে পারে, যুক্ত করতে পারে, এরকম জ্ঞান তাকে দিতে হবে। এই কাজ করবেন এমন শিক্ষকের সংখ্যা ক্রমাগতভাবে কমে আসছে। নানা কারণে এটা হতে পারে। বিশ্বায়নের চাপ রয়েছে, নানাভাবে নৈতিকতার স্খলনও আমরা দেখতে পাচ্ছি। একজন ভাল শিক্ষক একঝাঁক ভাল ছাত্র তৈরি করতে পারে। একটা জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। শিক্ষক দিবসে আমরা সকল শিক্ষককে সম্মান জানাব। আমি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আমাদের সকল শিক্ষককে সম্মান জানাই। আমরা যারা শিক্ষক রয়েছি তারা যেন সজ্জন হই, প্রকৃত শিক্ষক হই, শিক্ষকদেরকে সম্মান জানাতে শিখি, শ্রদ্ধা করতে শিখি। এগুলো যেমন দরকার তেমনি শিক্ষকদের দায়িত্বের যে জায়গাটি আছে, গবেষণার জায়গা, নতুন জ্ঞান তৈরি করার জায়গা, ছাত্রদের মধ্যে মুক্তবুদ্ধি চর্চার জায়গা তৈরি করা, তাদের নতুন জীবনদৃষ্টি, আত্মশক্তি উদ্বোধনের জায়গাটি মনে করিয়ে দেওয়ার কাজগুলো শিক্ষকদের করতে হবে। বিশ্বমানের শিক্ষা একটি আপেক্ষিক ব্যাপার। আমেরিকা তার দেশের নিজস্ব বিষয়াদি বিবেচনায় নিয়ে তাদের শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশও তাদের দেশীয় পরিপ্রেক্ষিত বা তার রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা, জনসম্পদের যে চরিত্র, তার প্রযুক্তির যে বিকাশ, তার অর্থনৈতিক যে আকাক্সক্ষা, তার ইতিহাসের যে ধারা এসবের পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যেকটা দেশ তার শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণ করে। আমরা যখন তুলনা করি যে, পশ্চিমের তুলনায় আমরা এগিয়ে যেতে পারছি বা পারিনি, এটাকে আমি খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না। আমার দেশের শিক্ষা কেমন হবে? আমার দেশের ইতিহাস, আমার দেশের মানুষের ভেতরের যে শক্তি বা সম্ভাবনা, আমার দেশের অর্থনীতি এসব বিষয় নির্ধারণ করে দিবে আমার দেশের শিক্ষার লক্ষ্য কি হবে। বৈশ্বিক শিক্ষাদর্শ একভাবে এগিয়েছে, কিন্তু ভারতীয় উপ-মহাদেশে শিক্ষা প্রাচীনকাল থেকে ভিন্নভাবে গড়ে ওঠেছে। আমরা কি চাই? মানুষ তৈরি করতে চাই, নাকি একেকজন কোনো একটা বিশেষ বিষয়ে দক্ষ বা জ্ঞান রাখে এমন মানুষ তৈরি করতে চাই। ভারতবর্ষের শিক্ষাদর্শনে প্রকৃতপক্ষে তুমি ভাল মানুষ হও, যার ভিতরে মনুষ্যত্ব থাকবে, মানবতা থাকবে, দেশপ্রেম থাকবে, নিজের জীবন নির্বাহের জন্য দক্ষতা থাকবে, দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য দেশপ্রেমও থাকবে। আমরা বহু সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তিতে বাস করি। আমরা আমাদের শিক্ষা দ্বারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ভাল মানুষ তৈরি করতে চাই। (চলবে)
পরিচিতি: সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট ও সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: মোহাম্মদ আবদুল অদুদ
সম্পাদনা: আশিক রহমান