আমরা ও আমাদের পরিবেশ
বিশ্বজগত এবং মানুষসহ তাতে যা রয়েছে সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহ তায়ালা। পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র, গ্রহ-উপগ্রহ, সাগর-মহাসাগর, পাহাড়-পর্বত, গাছ-পালা, তরুলতা, বন-জঙ্গল, পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ ইত্যাদি সব তিনিই সৃষ্টি করেছেন এক মহাপরিকল্পনার আওতায়। এর মধ্যে মানুষ হচ্ছে সৃষ্টির সেরা। মানুষকে তিনি জ্ঞান, বিদ্যা-বুদ্ধি দিয়েছেন। দিয়েছেন কথা বলার শক্তি ভাষাজ্ঞান। মনোনীত করেছেন স্বীয় খলিফা। মানুষের মাধ্যমেই তিনি তার নিজের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। সুতরাং মানুষ তার প্রিয় সৃষ্টি। এই প্রিয় সৃষ্টির স্বার্থেই অন্য সবকিছুই সৃষ্টি। মানুষের বেঁচে থাকবার জন্য প্রয়োজন মাটি, আলো, পানি, খাদ্যসহ আরও অনেক কিছু। তাই আল্লাহ তায়ালা মানুষ সৃষ্টির পরিকল্পনা আগে করলেও সৃষ্টি করেছেন পরে। আগে করেছেন মানুষের বেঁচে থাকার পরিবেশ। এই পৃথিবীকে আল্লাহ তায়ালা বহু বছর পূর্বে সৃষ্টি করেছেন। তারপর ধীরে ধীরে মানুষের উপযোগী করে মাটি, নদী-নালা, পাহাড়-পর্বত, বনজঙ্গল ইত্যাদি দিয়ে সাজিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা মানুষের বসবাস উপযোগী পরিবেশ তৈরী করে মানুষ সৃষ্টি করলেও এ মানুষ এখন তাদের জন্য পরিবেশ নষ্ট করে নিজেদের জীবন বিষবৎ করে তুলছে।
দেশের পরিবেশ দূষিত হওয়ার মূল কারল হলো, অধিক হারে যান্ত্রিক উন্নতি এবং এর ব্যাপক যথেচ্ছ ব্যবহার। দিনে দিনে প্রসার ঘটছে এসব দেশে শিল্প কারখানা। কলকারখানার তাপে ও বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ, গরম হচ্ছে বায়ুম-ল। উন্নত দেশের শিল্প-বর্জ্য শুধু যে সে দেশের বায়ু দূষিত করছে, তা নয় বরং সাগর-মহাসাগর দিয়ে তা প্রবাহিত হয়ে দূষিত হচ্ছে গরীব বিশ্বের উপকূল অঞ্চলও। বিনষ্ট হচ্ছে এসব উপকূলের মৎস্যসহ অন্যান্য সম্পদ। শিল্পোন্নত বিশ্ব কেবল তাদের উৎপাদিত পণ্যই বিক্রি করছে না, তাদের কলকারখানার বর্জ্যও পাচার করছে বিভিন্ন সাগর-মহাসাগরের ¯্রােতধারা ব্যবহার করে। বায়ু দূষণের মত শব্দ দূষণও পরিবেশ নষ্ট করে। জনসাধারণ বা পথচারীর বিরক্তি সৃষ্টি করে এমন জোরে মাইক, ক্যাসেট, রেডিও, গাড়ির ভেঁপু ইত্যাদি পরিবেশ নষ্ট করে। যানবাহন, রাস্তা বা অন্যান্য প্রকাশ্য স্থানে ধূমপান, থুথু ফেলা, পশু জবাই, কলার ছাল ফেলা ও নির্মাণ সামগ্রী রাখাও পরিবেশ দূষনের অন্তর্ভুক্ত। পরিবেশ রক্ষায় গাছ-পালার গুরুত্ব অপরিসীম। গাছ-পালা, তরুলতা মানুষ ও অন্যান্য জীব-জন্তুর খাদ্য সরবরাহ করে; জীবের জীবন ধরণের জন্য অক্সিজেন প্রদান করে জীবনের শ্বাস-প্রশ্বাস থেকে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইড বিষ ভক্ষন করে বায়ুকে দূষণ মুক্ত করে। মাটির ক্ষয়রোধ করে, ঝড় তুপান প্রতিরোধ করে। কাগজ শিল্পসহ আরও অনেক শিল্পে কাঁচামালের যোগান দেয়। গাছ মানুষের রোগ প্রতিরোধ করে। শাক-সব্জি, ও ফল-মূল থেকে মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধক উপাদান ভিটামিনের সৃষ্টি হয়। শুধু রোগ প্রতিরোধ নয়, প্রতিষেধক হিসেবেও গাছের ব্যবহার অতি প্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে। গাছ জীবকে সুন্দর জীবন ধারণের জন্য যেমন বিশুদ্ধ বাতাস দেয়, অপরদিকে তেমনি জীবের মল-মূত্র, গৃহস্থালি ও শিল্পের বর্জ্য, ময়লা আবর্জনা এ বিশুদ্ধ বাতাসকে দুর্গন্ধময় করে তোলে, যা জীবন ধারণের জন্য ক্ষতিকর। তাই যা কিছু বাতাসকে দুর্গন্ধময় করে, তা খোলা আকাশের নিচে রাখা উচিৎ নয়। হয় মাটিতে পুঁতে রাখা, নয়তো ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখা। সুতরাং মল-মূত্র ত্যাগের জন্য খোলা পায়খানা না বানিয়ে ঢাকনা যুক্ত গর্ত বানানো। অনুরূপ গরু ছাগলের গোবর, খাদ্য-দ্রব্যের খোসা, ঘরের ময়লা- আবর্জনা, শিল্পের বর্জ্য কোনো অবস্থাতেই যত্রতত্র খোলা আকাশের নিচে না ফেলে দূরে কোথাও কিংবা গর্ত করে রাখা। প্রতিবেশীর ক্ষতি এবং কষ্ট হয়, এমন কোনো ধরণের কাজ ইসলামে নিষিদ্ধ।
নদ-নদী, সাগর-মহাসাগর এগুলো মহান রাব্বুল আলামিনের দান। বর্জ্য ফেলে তা দূষিত করা বা এক দেশের বর্জ্য অন্য দেশে প্রাচার করা আলোকিত বা সভ্য মানুষের কাজ নয়। বন-জঙ্গল উজাড় করা যেমন বন্য প্রাণীর বংশ বিনষ্ট করা এবং বায়ু দূষণের শামিল, তেমনি নদ-নদী ও সাগর-মহাসাগরে বর্জ্য ফেলার অর্থ হচ্ছে পানি দূষণ এবং মৎস্যসহ অন্যান্য নিরীহ জলজ প্রাণী এবং উদ্ভিদের বিনষ্টি সাধন। এ ছাড়া খাল-বিল, নদ-নদী,পুকুর-জলাশয় ভরাট না করে নিজেদের পরিবেশ এবং আর্থিক স্বার্থে এগুলোকে নাব্য রাখতে হবে, মৎস্য চাষে ভরে ফেলতে হবে।
প্রতিটি ধার্মিক, সুশীল, আলোকিত ও সভ্য মানুষকে আর বিলম্ব না করে এগিয়ে আসতে হবে পরিবেশ রক্ষার সংগ্রামে। এ ব্যাপারে উন্নত-অনুন্নত ও পরিবেশ অসচেতন দেশের জ্ঞানী-গুনী, চিন্তাশীল, ধার্মিক ও শিক্ষিত ব্যক্তিদের দায়িত্ব অনেক বেশী। তাহলে আমরা পাবো সুন্দর ও সুগঠিত একটি পরিবার, একটি সমাজ, একটি দেশ। লেখক: শিক্ষক, মাদরাসা বাইতুন নূর ঢাকা।