ঔষধের অসুস্থতা সাড়াবে কে?
রোগবালাই তো আছে দুনিয়ায়, ভাল থাকার আছে যে উপায়। হ্যাঁ, এই ভাল থাকার উপায়গুলোর একটা হলো, রোগ হবে ঔষধ খাবে, রোগী ভাল হবে এটাই নিয়ম। কিন্তু এই ভাল হওয়া বা সেড়ে ওঠার জন্য যে ঔষধ, সেটা যদি ভাল না থাকে তাহলে অসুখ ভাল হবে কিভাবে? মানসম্পন্ন ঔষধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুনাম অর্জন করেছে। দেশের চাহিদা পুরণের পাশাপাশি বাংলাদেশ এখন ঔষধ রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ে উঠে এসেছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাতগুলোর একটি এখন ঔষধ। বর্তমানে খুব অল্প কিছু ঔষধ ছাড়া বিদেশ থেকে ঔষধ আমদানিও কমে গেছে। মানসম্পন্ন ঔষধ উৎপাদনেরও এই সুনামের দিকটি নিয়ে প্রশ্ন ওঠার এখন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
ঔষধ উৎপাদন থেকে শুরু করে বিতরণ বা সংরক্ষণ সকল কিছুই যথাযথ তদারকি ও নিয়মের ভিতর থেকে হওয়া উচিত। ঔষধ যেমন মানুষের প্রাণ বাঁচাতে সাহায্য করে তেমনি আবার প্রাণনাশেরও কারণ। ঔষধ উৎপাদনের কাঁচামাল থেকে শুরু করে তৈরি ও সংরক্ষণের তাপমাত্রা, উৎপাদনে ব্যবহার ও প্রয়োগ, সঠিক নিয়ম মেনে হচ্ছে কিনা তা দেখার বিষয়। কারণ দেশে এখন অনেক ছোট বড় ঔষধ কারখানা রয়েছে, যারা মিডফোর্ড থেকে কাঁচামাল কিনে থাকে। আমি বলছি না, মিডফোর্ড থেকে কাঁচামাল কেনা দোষের কিছু। তবে এসব ঔষুধ তৈরির ইনগ্রিডিয়েন্ট (এপিআই) যা ঔষধের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়, তার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, কে কোন ধরনের ঔষধ বিক্রি করবেন, কোন তাপমাত্রায় সেগুলো রাখতে হবে, বিক্রেতাদের লাইসেন্স দেওয়ার সময় তা উল্লেখ করে দেওয়া হয়। এসব শর্ত সঠিকভাবে মেনে চলা হচ্ছে কি না, তা তদারকি করার জন্যে তাদের মাঠ কর্মী রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি এখন পর্যন্ত যা যা শর্তের কথা বলা হয়েছে সেগুলো অমান্য করার দায়ে কাউকে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে তার নজির নেই। যদিও এসব শর্তের লঙ্ঘন ঘটেই চলছে অহরহ। বেসরকারিই শুধু নয়, সরকারি পর্যায়েও ঔষধ সংরক্ষণের নিয়ম পুরোপুরি মানা হচ্ছে না। অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালেই ঔষধ সংরক্ষণের উপযুক্ত ব্যবসা নেই।
ঔষধ সংরক্ষণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে, যে নীতিমালায় সংরক্ষণ কক্ষের আদ্রতা ৬০ শতাংশের নিচে রাখার কথা বলা আছে, ক্ষেত্রবিশেষে সংরক্ষণ কক্ষে শীতাতপ নিয়ন্ত্রন যন্ত্র থাকার কথাও বলা রয়েছে। তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে আছে কিনা তা দেখার জন্যে কক্ষের একাধিক স্থানে থার্মোমিটার রাখার কথা বলা রয়েছে। সর্বোপরি কক্ষের আয়তনভেদে একাধিক ফ্রিজার বা রেফ্রিজারেটরের ব্যবস্থা রাখার কথাও বলা হয়েছে। এ থেকে উৎপাদিত তাপ বের করে দেওয়ার জন্যে একাধিক এগজাস্ট ফ্যানের ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। কারণ, ঔষধ তৈরিতে সঠিক নিয়ম অনুসরণ করা হলেও সংরক্ষণ দুর্বলতায় এর গুণাগুণ অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়। যেমন অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধ সংরক্ষণের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ভ্যাকসিন, ইনসুলিন ও হরমোন জাতীয় ঔষধ সংরক্ষণে প্রয়োজন হয় আরও কম তাপমাত্রা, ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু আমরা এসব নিয়ম মেনে চলা ফার্মেসির সন্ধান পাব খুবই কম। আর তাতে করে ঔষধের গুণাগুণ কতটুকু সঠিক থাকতে পারে তাও বিবেচ্য বিষয়।
বিশেষজ্ঞেরা বলেছেন, ঔষধ সংরক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়, ঔষধ ভেদে এটি কম বেশি হতেই পারে। আমরাও দেখেছি প্রত্যেকটা ঔষধের প্যাকেটের গায়ে তাপমাত্রার বিষয় উল্লেখ করা থাকে। তাপমাত্রার হেরফের মানেই ঔষধের গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যাওয়া। কিন্তু আমরা বড় বড় মেডিসিন স্টোরে গিয়ে কি দেখতে পাই? পুরো কক্ষে, মেঝে, বারান্দায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ঔষধের কার্টুন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থাকলেও তার ব্যবহার সঠিক মতো হয় না। রাজধানী সহ দেশের বড় শহরগুলোর অনেক ফার্মেসির ঔষধ সংরক্ষণের উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই। ফ্রিজার ছাড়াই ঔষধ বিক্রি করছে অধিকাংশ ফার্মেসি। অনেকে আবার জানেও না যে ঔষধ আবার নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। আর যে সব এলাকায় বিদ্যুৎ পৌঁছেনি, সেখানকার পরিস্থিতিতো আরও ভয়াবহ। আমরা জানি আমাদের দেশের তাপমাত্রা ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরই থাকে সবসময়। ঔষধের মতো উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় এই রপ্তানিকারক খাতের দিকে নজর দেওয়া সরকারের একান্ত কর্তব্য। তার চেয়েও বড় কথা, এর সঙ্গে মানুষের বাঁচা মরার প্রশ্ন জড়িত।
দেশের প্রয়োজনে, মানুষের প্রয়োজনে এবং রপ্তানিকারক পণ্য হিসেবে ঔষধকে অবহেলার কোনো সুযোগ নেই। সেই সঙ্গে ঔষধ সংরক্ষণ ও তৈরির মান বজায় রাখার ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টিতে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : পরিচালক, সিসিএন
সম্পাদনা: আশিক রহমান ও মোহাম্মদ আবদুল অদুদ