বিশ্বব্যাপী জ্ঞান নিয়ে রাজনীতি চলছে
দুলাল চন্দ্র বিশ্বাস
পশ্চিমে যে সমস্ত পরিপ্রেক্ষিত ও বাস্তবতার নিরিখে তাদের শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে, আমাদেরটা ঠিক একইরকমভাবে হবে না। সে কারণে আমি বলতে চাই আমাদের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের শিক্ষা, আদর্শ, শিক্ষার মান নির্ধারণ করতে হবে এবং সেটা আমাদের এগিয়ে নিতে হবে। তার সঙ্গে বাইরের তুলনা কখনো কখনো আসতে পারে। কিন্তু বাইরের তুলনা সব সময়ই যে প্রয়োজনীয় এ রকম নয়। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার অবস্থা খুবই খারাপ, মাধ্যমিক শিক্ষার অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। পাঠ্যপুস্তক নিয়ে ভালো করে বসা দরকার। আমাদের এখানে বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে নানা সময়ে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে কথা বলা হয়েছে। ভাল করে দেখা দরকার, কোন প্রতিষ্ঠানে কী পড়ানো হচ্ছে? কারা কারিকুলাম তৈরি করছে? কিসের ভিত্তিতে তৈরি করছে সেটার উপর গবেষণা হওয়া উচিত, দেখা উচিত। পাঠ্যপুস্তক দিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোন বোধ, কোন জ্ঞান, কোন আদর্শ সঞ্চারিত হচ্ছে সেটাও দেখা উচিত। তার পরিপ্রেক্ষিতে তারা কি রকম মানুষ হিসেবে তৈরি হচ্ছে সেটা দেখা দরকার। এগুলো মূল্যায়ন করা দরকার। এই বিষয়গুলো চিন্তা করা প্রয়োজন। টোটাল কারিকুলাম আবার বিবেচনা করা উচিত। একটা কথা বলা দরকার যে, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ যে তার ভ্রাম্যমান লাইব্রেরী গড়ে তুলেছেন, বই নিয়ে গাড়ি ঘুরে সারাদেশে। আমাদের সাংবাদিকরা কী কখনো দেখেছেন, ওখানে কোন বই, কিসের বই? তিনি জ্ঞানের আলো বিতরণ করছেন কিন্তু কোন বই দিয়ে? শিশুদেরকে কোন বইগুলো পড়তে দেওয়া হচ্ছে? সে বইগুলোর মান কেমন? সেখানে বিদেশি রূপকথা কেন? কেন নয় আমাদের দেশের রূপকথা, আমাদের দেশের ভাল বই? লক্ষ্য করবেন, সেখানে শিশুদের উপযোগী বইয়ের সংখ্যা একেবারেই কম।
আমাদের টেক্সটগুলো দেখা দরকার আছে। পরিবর্তন আনয়ন দরকার। পরিবর্তন দেখতে হলে পশ্চিমের উন্নয়ন প্রক্রিয়া দেখতে হবে। কিন্তু সেটা আমাদের আদর্শ নয়। আমাদের দেশের বাস্তব প্রয়োজন কী? সেই প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে সকল শিক্ষাস্তরে কারিকুলারের পরিবর্তন ঘটাতে হবে। প্রকৃতপক্ষে দেশের কথা মাথায় রেখে কারিকুলার তৈরি করতে হবে। সেই জায়গাটাতে যোগ্য লোকদের সুযোগ দিতে হবে। সেখানে চেনা জানা লোক দিয়ে নয়, প্রকৃত পন্ডিত যারা আছেন, তাদের ডেকে নিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত কারিকুলার তৈরি করতে হবে। যখন দেখবেন আমাদের কারিকুলার দেশের অর্থনীতি, দেশের রাজনীতি, সমাজ পরিকল্পনা, মানবিকতার উন্নয়নের ক্ষেত্রে কাজ করছে, তখন পশ্চিমা দেশগুলো আমাদের সঙ্গে তুলনা করবে, আমরা কি বাংলাদেশের মতো এগিয়েছি? কিন্তু আমরা উল্টো কাজ করছি। আমরা পশ্চিমের মতো এগোচ্ছে কি-না দেখছি। আমরা কেন তাহলে তাদের গল্প শুনব? আসলে জ্ঞান নিয়ে বৈশ্বিক রাজনীতি চলছে। যারা আমাদের প্রভু রাষ্ট্র ছিল উপনিবেশ আমলে, তারা জ্ঞানকে নিয়ন্ত্রণ করছে। পরবর্তী কালে দেখা যাচ্ছে যে, যে সমস্ত দেশের হাতে সামরিক শক্তি আছে, জ্ঞান তৈরি ও জ্ঞানের বৈধতা দেওয়ার লাইসেন্স তারা নিয়ে নিয়েছে। সুতরাং প্রকৃত জ্ঞানকে বুঝে নিতে হবে, জ্ঞান রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদেরকে একটা জ্ঞানতত্ত্ব তৈরি করতে হবে। আমাদের এখানে তো ছিল। আমরা যদি বাংলার প্রাচীন জ্ঞান ঐতিহ্য দেখি, আমরা কখনো মূর্খ জাতি ছিলাম, এটা কখনো প্রমাণিত হবে না। আমাদের সভ্যতা কিন্তু বহু পুরনো। সেই ঐতিহ্যের জায়গাটায়,বিশ্বাসের জায়গাটায়, আত্মশক্তির জায়গাটায় ফিরে যেতে হবে। সেখান থেকে আমাদেরকে নতুন পৃথিবীর জন্য জ্ঞান তৈরি করতে, জ্ঞান সংগ্রহ করতে, জ্ঞানতত্ত্ব তৈরি করতে হবে। গবেষণা করতে হবে। শিক্ষক দিবসে শিক্ষকদের এ রকম একটি প্রতিজ্ঞা থাকা উচিত।
পরিচিতি: সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট এবং সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: মোহাম্মদ আবদুল অদুদ
সম্পাদনা: আশিক রহমান