রোহিঙ্গা সংকট : কেন এই গণহত্যা
হাজার বছর ধরে মিয়ানমারের (বার্মা) নাগরিক, রাখাইন (আরাকান) রাজ্যের আদিবাসি রোহিঙ্গা, বর্মী সেনাবাহিনীর বর্বর দমনাভিযানের মুখে জন্মভূমিতে টিকতে না পেরে চৌদ্দ পুরুষের ভিটে-মাটি, সহায় সম্বল সবকিছু ফেলে পালিয়ে আসা শরণার্থী। পরিবার-পরিজন হারিয়ে জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে আসা তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গা নর-নারী, শিশু-বৃদ্ধ এখন ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত ও আশ্রয়হারা। এদের মধ্যে অনেকে গুলিবিদ্ধ, আগুনে দদ্ধসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। শিশুরা চরম অপুষ্টিতে কাহিল। সেই ভাগ্যাহত রোহিঙ্গাদের পাশে খাদ্য, বস্ত্র, ঔষধ সহ ত্রাণ সাহায্য সামগ্রী এবং নগদ অর্থ সহায়তায় দেশের মানুষ ও সরকার এগিয়ে আসছে এবং তা অব্যাহত রাখতে হবে।
১৯৪৫ থেকে ২০১৭। টানা ৬৫ বছর, রোহিঙ্গা মুসলমানরা নির্মম নির্যাতন ভোগ করছে। বিনা কারণে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, জ¦ালাও-পোড়াও চলছে। পৃথিবীর সবচেয়ে জঘণ্য নির্মম গণহত্যা শুরু ২৫ আগস্ট ‘অন্ধকার সাপ’ ইস্যুকে কেন্দ্র করে। মিয়ানমার সরকারের সৃষ্ট সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদের নাটকীয় সীমান্ত চৌকির হামলাকে কেন্দ্র করে রক্তচোষা অং সান সু চির রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী এ পর্যন্ত বিনা অপরাধে নির্মমভাবে ৪ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আরাকানে (রাখাইন) থেকে মিয়ানমার সরকারের রোহিঙ্গা উচ্ছেদ এবারই নয়। ১৯৭৮ সালেও দমন-নিপীড়ন চালিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসতে বাধ্য করেছিল। ১৯৮২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে নাগরিকত্ব নামক ‘কালো আইন করে’ মসুলিম নিধনের আড়ম্বরতাকে বাড়িয়ে দেয়। দেরিতে হলেও মিয়ানমারের গণহত্যার উলঙ্গ চিত্রটি বিশ^দরবারে পৌঁছতে শুরু হয়েছে।
১৯৯১-৯২’ তেও আরাকানে রোহিঙ্গা উচ্ছেদ অভিযান চালায়। সে সময়ও ৩ লাখ রোহিঙ্গা এই দেশে আসতে বাধ্য হয়। ২০১২ সালের শেষ দিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার-নিপীড়নে হাজার হাজার রোহিঙ্গা পূর্বের মতো জীবন বাঁচাতে আবারও বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ২০১৬ তেও রোহিঙ্গাদের আরাকান থেকে উচ্ছেদের জন্য নির্মম অভিযান চালায়। সে সময় ও দলে দলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হয়। ২৫ আগস্ট থেকে সে দেশের সেনাবাহিনী আরাকানে স্মরণকালের ভয়াবহ রোহিঙ্গা নিধন অভিযান শুরু করে। ২০০৪ সালের দিকে আরাকান রাজ্যে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের সন্ধান পায়। এর পর থেকেই রোহিঙ্গা নির্মূলের পরিকল্পনা করে মিয়ানমারের সামরিক সরকার। আরাকান রাজ্য থেকে চীন পর্যন্ত গ্যাস পাইপ লাইন বসানোর ব্যাপারে সমঝোতা হয় এবং আরাকান রাজ্য ঘিরে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘মাস্টার প্ল্যান’ তৈরি করে। এরপর থেকেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর ধারাবাহিক নির্যাতন শুরু। এবার রোহিঙ্গা সংকটের নেপথ্যে শক্তিধরদের ‘গ্রেটগেম’ এর সন্দেহ উড়িয়ে দেওয়া যায় না। প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয় শক্তিধর এক বা একাধিক দেশের ‘গ্রেট গেম’ এর ক্ষেত্র হয়েছে আরাকান রাজ্য এবং বলি হয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। অর্থনৈতিক ও আধিপত্যের স্বার্থে প্যালেস্টাইনীদের নিজ ভূখ- থেকে উচ্ছেদ করে যাযাবর জনগোষ্ঠীতে পরিণত করার উদাহরণ চোখের সামনে রয়েছে।
মিয়ানমারের গণহত্যার নির্মম মিশন থেকে জীবন বাঁচাতে এযাবৎ বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। ১৯৪৫ থেকে ১৯৭০ (২৫ বছর তৎকালীন পাকিস্তান)। ১৯৭০ থেকে ২০১৭ অর্থাৎ ৪৭ বছর যাবৎ বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা শরনার্থীদের দেখভাল করছে। বাংলাদেশ সরকারের বিগত ৪৭ বছরের মানবিক কর্মকা-ের জন্য এদেশের কোনো রাষ্ট্রপ্রধান নোবেল বিজয়ী না হলেও সেনা আশ্রিত সু চি ঠিকই নোবেল বিজয়ী। পৃথিবীর ১৯৬টি দেশের সাড়ে ৬ কোটি মানুষ গৃহহারা, নির্যাতিত, নিপীড়িত, নিগৃহীত। এর মধ্যে সবচেয়ে কলংকজনক অধ্যায়ের সাক্ষ্যবহন করছে মিয়ানমারের মুসলিম জাতিগোষ্ঠি রোহিঙ্গারা। সে দেশের সেনাবাহিনী ও সাধারণ বৌদ্ধ তরুণদের গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ^ মানবতার অগ্নিস্ফুলঙ্গ এখন কেন ঘটছে না! মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস তখনই দ্রুত বন্ধ হবে, যখন বিশ^ মোড়ল যুক্তরাষ্ট্র, ভারত চীন একযোগে, এক বাক্যে মানবতার পক্ষে সুদৃঢ় অবস্থান করে এবং বাংলাদেশ সরকার যদি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকারের নীতি গ্রহণ করে তবেই মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বন্ধ হবে এটা নিশ্চিত। একই সঙ্গে মানবিক দুর্যোগ মুহূর্তে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ক্যাম্প, শরণার্থীরা যাতে কোনো ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’ না লাগে, সেদিকে সতর্কতার সাথে নজর রাখা।
বিশ্বে এখন সবচেয়ে নির্যাতিত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠির নাম ‘রোহিঙ্গা মুসলিম’ মিয়ানমারে ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর তাদের দুঃখগাঁথা শুরু হলেও তা ঘণীভূত হয় ১৯৬২ তে, দেশটিতে জান্তা সরকারের আমলে। সংকুচিত হতে থাকে রোহিঙ্গাদের বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারও। অসহ্য নিপীড়নের মুখে গত সাড়ে ৪ দশকে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছে ১৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গা।
১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের রোহিঙ্গা স্বাধীন রাজ্য ছিল। মিয়ানমারের রাজা বোদাওফায়া এ রাজ্য দখল করার পর বৌদ্ধ আধিপত্য শুরু হয়। এক সময় ব্রিটিশদের দখলে আসে এ ভূখ-। বিভাজনের নীতির প্রবক্তা ব্রিটিশদের ইচ্ছাকৃত ভুলের মাশুল গুণছে রোহিঙ্গারা। এর দায় ব্রিটিশ এড়াতে পারে না। তারা মিয়ানমারের ১৩৯টি জাতি গোষ্ঠীর তালিকা করে তার মধ্যে রোহিঙ্গাদের নাম ছিল না। ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীনতা লাভ এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু। সে সময় পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল এবং কয়েকজন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও ছিল। ১৯৬২ সালে জেনারেল নেউইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্টক্ষমতা দখল করলে সেদেশের যাত্রা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে থাকে। শুরু হয় রোহিঙ্গাদের উপর দুর্ভোগ।
তাদের নাগরিক অধিকার। ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ধর্মীয়ভাবে অত্যাচার হতে থাকে। নামাজ আদায়ে বাধা, হত্যা, ধর্ষণ নিয়মিত ঘটনা। বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা। তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবার সুযোগ নেই। বিয়ে করার অনুমতি নেই। সন্তান হলে নিবন্ধন নেই। তাদের উপর একের পর এক বিধিনিষেধ। অথচ তাদেরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে। জনগনের উপর এমন নিষ্ঠুর অত্যাচার করার অধিকার কোনো দেশের নেই। আমরা জানতাম বৌদ্ধ ধর্ম অন্যান্য ধর্মের তুলনায় অনেক বেশি মানবিক। তাদের ধর্মে জীব হত্যা মহাপাপ। আশ্চার্য্যরে বিষয়। রোহিঙ্গা জনগণ কি মানুষ বা জীব এর মধ্যে পড়ে না বা বিবেচিত হয় না। ভোটের জন্য, ক্ষমতার জন্য নোবেল বিজয়ী সে দেশের ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী অং সান সু চি এভাবে মানুষের উপর অন্যায় অত্যাচারকে প্রশ্রয় দিতে পারে না। শান্তির জন্য নোবেল পেয়ে দেশের মানুষের উপর এমন নিষ্ঠুর অত্যাচার, যা আদিম বর্বরতাকেও হার মানায়।
লেখক: কলামিস্ট
লধযধহমরৎলধনরৎ৫@মসধরষ.পড়স
সম্পাদনা: আশিক রহমান