‘দুরন্ত’ টিভির জন্য নির্মল ভালোবাসা
মঞ্জুরুল আলম পান্না
খবরটা হয়তো অনেকের কাছে ছোট, কিন্তু আমার কাছে অনেক অনেক বড়। আমি সত্যিই মুগ্ধ, আনন্দিত। দেশে মুড়ি-মুড়কির মতো স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলের মধ্যে নতুন করে সম্প্রচারে আসা কোনো চ্যানেলের জন্য উচ্ছ্বাসিত হওয়ার কিছু নেই বটে। তবে ‘দুরন্ত’ নামে যে চ্যানেলটি পরীক্ষামূলক সম্প্রচারে এসেছে মাত্র কদিন আগে তাকে প্রগাঢ় ভালোবাসায় স্বাগত জানাই আগেভাগে। কারণ একটিই, তা হলো চ্যানেলটি শিশুতোষ। শুধু আমি নই, আমার ছয় বছরের সন্তান সুরশ্রেয়া সত্তা উচ্ছাসিত আরও বেশি। ওর চোখে মুখে ফুঁটে উঠেছে নির্মল আনন্দের নতুন কিছু আবিষ্কারের উত্তেজনার প্রতিচ্ছবি। শিশুদেরও যে নিজস্ব ভাবনা রয়েছে, সেই ভাবনা যে নিজেদের ভবিষ্যৎ গঠনে আর দেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে তা আমরা ভুলেই গেছি। তাদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা আর মতামত প্রকাশে বিশেষ কোনো প্লাটফর্মের অভাবে বড্ড দুঃসময়ের মধ্যে এরকম একটি চ্যানেলের জন্ম হওয়ার অর্থ হলো অনেক সংকটের মাঝেও আশাবাদীতার একটা ক্ষেত্র খোঁজে পাওয়া। ষোল কোটি মানুষের এই দেশে শিশুর সংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি। অথচ তাদের বিনোদনের জন্য, সৃজনশীল কাজে উৎসাহ দেওয়ার জন্য, বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তোলার জন্য ভালো কোনো বই, পত্রিকা, প্রতিষ্ঠান নেই বললেই চলে, টেলিভিশন চ্যানেলতো দূরের কথা। ছোট বেলায় আমাদের হাতে খড়ি হয়েছে শিশু সংগঠন ‘খেলাঘরের’র মাধ্যমে। তখন শিশুদের সৃজনশীল মনোজগৎ সৃষ্টির জন্য অনেক কিছুই ছিল, যা এখন নেই। দেশের যুবসমাজের একটি বড় অংশ বিপথগামী হওয়ার পেছনের অন্যতম কারণ খেলাঘর, কচিকাঁচার আসর, চাঁদের হাটের মতো সংগঠনের দীর্ঘদিনের অভাব এবং বই পড়া চর্চা নষ্ট হয়ে যাওয়া। একটি সুস্থ এবং সৃজনশীল জাতি গঠনে গণমাধ্যমের ভূমিকা যে ব্যাপক। সে কথা আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো এখন আর মনে রাখতে চায় না। শিশুদের উপযোগী করে যেকোনো অনুষ্ঠান তৈরি বেশ চ্যালেঞ্জের। ‘দুরন্ত’ টিভির অনুষ্ঠান প্রোমোগুলো দেখে মনে হলো প্রতিষ্ঠানটি শিশুদের মনের চাওয়া অনেকখানি পূরণ করতে পারবে। চ্যানেলটির লোগো উন্মোচন অনুষ্ঠানে কতৃপক্ষ জানিয়েছে ‘শিশুদের মনোজগতে ক্রিয়াশীল যে কোনো তথ্য, সংবাদ, কাহিনি ও বিনোদনের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের ভবিষ্যৎ গঠনের গুরুত্বের কথা বিবেচনা করেই দুরন্ত টেলিভিশনের যাত্রা’। একান্তভাবে কামনা, তাই-ই যেন হয়। আরও চাইব- বিজ্ঞাপনের আধিক্যে শিশুদের আকর্ষণে যেন কোনো প্রকার ভাটা না পড়ে, মানহীন অনুষ্ঠানে যেন কখনো বিরক্তির সৃষ্টি না করে শিশু মনে। চাইব- সেখানে গান, নাচ, কবিতা, নাটক, খেলাধুলা সংক্রান্ত অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বিজ্ঞানভিত্তিক অনুষ্ঠান হোক বেশি বেশি, শিশু অধিকারের কথা বলা হোক, শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা বলা হোক, প্রতিবন্ধী শিশুদের কথা বলা হোক। বিদেশি চ্যানেল বিশেষ করে ভারতীয় চ্যানেলের অবাধ প্রবেশে আমাদের শিশুরা ভয়ঙ্কর এক অপসংস্কৃতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। যদিও এক্ষেত্রে বিদেশি কোনো চ্যানেলের দোষ দিয়ে লাভ নেই। দেশি যে দুই-তিন ডজন চ্যানেল রয়েছে তার অনুষ্ঠান এবং সংবাদের মান নিয়ে রয়েছে অনেক প্রশ্ন। আর শিশুদের জন্য বিজ্ঞানমনস্ক এবং সৃজনশীল কোনো অনুষ্ঠান নির্মাণ তো দূরের কথা, কোনো ভাবনাই সম্ভবত নেই। যেটুকুও বা হয় তা সেই শিশুদের কাছেই যে গ্রহণযোগ্য নয় তা বলা বাহুল্য। পুঁজির বাজারে শিশুদের জন্য ভাববার সময়ই বা কোথায় আমাদের! তবে একুশে টেলিভিশনের ‘মুক্ত খবর’ নামের অনুষ্ঠানের জন্য প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকাকে অবশ্যই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হবে সব সময়।
শিশুদের জন্য চ্যানেলগুলোতে বিশেষ কোনো সময় বরাদ্দ নেই বলেই কিছু দিন আগে চ্যানেলগুলোর কাছে জাতিসংঘের ইউনিসেফের পক্ষ থেকে শিশুদের জন্য বিনা পয়সায় এক মিনিট বরাদ্দের আবেদন জানিয়েছে। কয়েকটি চ্যানেল সেই সময় দিয়েছে। কৃতজ্ঞতা তাদের প্রতি। হোক না সামান্য এক মিনিট, তাতে কী…। শিশুদের গুরুত্ব উপলব্ধিতে এসেছে, এটাই বড় কথা। সব শিশু জেগে থাকুক, তাদের স্বপ্নেরা ডানা মেলুক। জয় হোক বাংলাদেশের। প্রয়োজন শুধু তাদের প্রতি আমাদের নির্মল ভালোবাসা আর বিশুদ্ধ প্রতিশ্রুতির।
লেখক: সাংবাদিক/সম্পাদনা: আশিক রহমান