চাল ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স প্রদান ও চালের হিসাব নেওয়া অপ্রয়োজনীয়
সরকার দু-চারদিন আগে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, চালের ব্যবসা করতে হলে লাইসেন্স নিতে হবে এবং পনের দিন অন্তর অন্তর চালের স্টকের হিসাব দিতে হবে। এটি একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। কোনো অবস্থাতেই একটা ফ্রি এন্টারপ্রাইজ সিস্টেমে আমরা এরকম করতে পারি না। যেখানে বলা হয় অবাধ মুক্তবাজার, সেখানে ব্যবসা বাণিজ্যের মধ্যে কিছু কিছু সমস্যা থাকবে, ব্যবসায়ীরা মজুদদারি করবে, অতি মুনাফা করার চেষ্টা করবে। সেগুলো করার জন্য বাংলাদেশে বিদ্যমান অনেক আইন আছে। এই আইনের আওতায় তাদের মজুদদারি রোধ করা যায়। তাদের অতি লোভ নিরোধ করতে গেলে সেগুলো মনিটরিং করা লাগবে। সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিদ্যমান যে আইনগুলো রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে সীমিত থাকলেই যথেষ্ট। নতুন করে যদি এখন এই চালের ব্যবসা করার জন্য লাইসেন্স এর ব্যবস্থা চালু করা হয়, তাহলে আবার ১৯৭৪ সালে লাইসেন্স নিয়ে যে কেলেঙ্কারি হয়েছিল, একই কেলেঙ্কারিতে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে।
অর্থাৎ চালের বাজারকে নিয়ন্ত্রণে রাখার যে উদ্দেশ্যে এটা করা হচ্ছে, সেটা ভ-ুল হবে এবং সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হওয়ার জন্য এই একটা বিষয়ই যথেষ্ট। এখন যেটা করতে হবে, বাংলাদেশ সরকারের যে খাদ্যগুদামগুলো আছে, সেগুলোতে ১০ লক্ষ টন খাদ্য মজুদ সবসময় রাখতে হবে। এটা রপ্তানি করে হোক আর যেকোনোভাবেই হোক। এটা যদি ব্যবসায়ীরা নিশ্চিত হয়, বাজারের সংশ্লিষ্টরা যদি নিশ্চিতভাবে জানে যে, সরকারের হাতে ১০ লক্ষ টন খাদ্য মজুদ আছে, তাহলে খুব একটা সমস্যা হবে না। কারণ, ১০ লক্ষ টন খাদ্য দিয়ে আড়াই মাস থেকে তিন মাস পর্যন্ত চলে। আর আড়াই মাস থেকে তিন মাস চললে, এই সময়ের মধ্যে আমাদের মধ্যে একটা না একটা ফসল আসেই। অতএব, ১০ লক্ষ টন খাদ্য মজুদ নিশ্চিত করাই হবে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মূল কাজ এবং কোনো অবস্থাতেই যেন খাদ্যের এই মজুদ না কমে।
এটার জন্য খাদ্যমন্ত্রীকে আমাদের উপর নির্ভর না করে নিয়মিত খাদ্যগুদাম পরিদর্শনে যেতে হবে। তিনি যখনই যে জেলায় যাবেন, সেখানে খাদ্য গুদামে যাবেন, শুধু খাদ্য গুদামের বাইরে গিয়ে রেকর্ড দেখলেই হবে না। উনি ভিতরে গিয়ে বস্তাগুলো চেক করে দেখবেন। খাদ্যমন্ত্রীর কাজ হলো বস্তাগুলো খুলে দেখা। এই কথাটি আমি এর আগেও বলেছিলাম, এতে তারা কোনো সাড়া দেয়নি। এটা ছাড়া চালের ব্যাপারে অন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করলে মারত্মক প্রতিক্রিয়া হবে বাজারে। এবং উল্টো হবে। এজন্য সরকারকে তার যে খাদ্য কর্মসূচিগুলো আছে, সেগুলো নিয়মিত চালানোর জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ তার কাছে থাকতে হবে। আর যতদিন পর্যন্ত চাল এবং গমের স্বল্পতা থাকবে, ততদিন পর্যন্ত আলু বিকল্প হিসেবে রাখতে হবে। যাদেরকে ১০ কেজি করে চাল দেওয়া হতো, ৩০ কেজি করে গম দেওয়া হতো, বিভিন্ন কর্মসূচিতে তাদেরকে আলু দেওয়া যেতে পারে। কারণ, ২০ লক্ষ টন আলু নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। গরিব মানুষের জন্য যে সকল খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো আছে, সেগুলোতে অনতিবিলম্বে চালের বদলি আলু দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। সরকারের খাদ্য নিরাপত্তার যে সকল কর্মসূচি আছে, সেসকল কর্মসূচিতে ইমিডিয়েটলি আলু দেওয়া যেতে পারে। কোনোভাবেই নতুন করে চালের লাইসেন্স চালু করা উচিত হবে না এবং এতে বাজারে বিশৃঙ্খলা বাড়বে। ১০ লক্ষ টন খাদ্য মজুদ নিশ্চিত করতে হবে, এটা যেন ব্যবসায়ীরা সব সময় জানে এবং এই স্টকটা যেন শুধু কাগজে-কলমে না হয়ে সত্যিকার অর্থেই গুদামে থাকে। যতগুলো খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচি রয়েছে সেগুলোর কোনোটাই বন্ধ করা যাবে না। খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোতে অনতিবিলম্বে চালের বদলি আলু দেওয়া হোক। আলু দিলে কৃষক উপকৃত হবে।
কারণ, আলু বিক্রি হচ্ছে না, গোডাউন থেকে আলু বের করা হচ্ছে না। একদিকে গোডাইন ভাড়া দিতে হয়, আরেক দিকে সুদের উপরে যারা গোডাউন করেছিল, তারাও ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। সেজন্য ইমিডিয়েটলি খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচিতে আলু সরবরাহ করা যেতে পারে। ২০০৭-২০০৮ সালের সামরিক সরকার যেমন আলু খেতে বলেছিল, এখানে এটার দরকার নেই। যাকে চাল দেওয়া হতো, তাকে আলু দেওয়া হোক। সে ক্ষেত্রে সে আলু খাক বা ফেলে দিক, তাতে কোনো যায় আসে না। সবাইকে আবার যাতে আলু খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া না হয়, সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। আলু দেওয়া হবে, সে ইচ্ছে করলে আলু বিক্রি করে দিবে।
পরিচিতি: উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
অনুলিখন : সাগর গনি
সম্পাদনা : আশিক রহমান ও মোহাম্মদ আবদুল অদুদ