ব্যর্থ, অকার্যকর জাতিসংঘ!
ঘুম থেকে উঠে যদি কেউ শুনে সে যে দেশে জন্ম নিয়েছে, বেড়ে উঠেছে, যে দেশের মাটি ও মানুষ তার প্রাণ থেকেও প্রিয়। সেই দেশ নাকি তার নয়। কেউ এসে বলল, বাঁচতে হলে সবকিছু ছেড়ে এখনই, এই মুহূর্তে চলে যেতে হবে! কিন্তু কোথায় যাবেন তাও সে জানে না, তখন তার কেমন লাগবে? পিছন ফিরে দেখছেন জ্বালাও, পোঁড়াও। চোখের সামনে ধর্ষিতা প্রাণপ্রিয় মা, বোন, মেয়ে ও স্ত্রীর করুণ আর্তি। প্রিয় পাঠক, অনুভব করার চেষ্ঠা করুন! কথাগুলো স্বপ্ন দেখার সংলাপ নয়, পুরোপুরি বাস্তবতাই আজ মিয়ানমারে। অথচ রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে তামাশা, প্রহসন, নিষ্ফল ও ব্যর্থ আলোচনার মহড়াই হলো?
আজ পর্যন্ত কোনো দেশের সাথে কোনো দেশের সমস্যা হলে সেটার সমাধান ও নিরাপত্তা পরিষদের উন্মুক্ত আলোচনায় কখনো কার্যকরি সিদ্ধান্ত নেওয়ার নজির আছে কী? যদি জাতিসংঘ বিপদাপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে না পারে, তাদের রক্ষা করতে না পারে তবে এটা থেকে লাভ কী? কী নির্মম পরিহাস, ধিক শত ধিক। কী লজ্জা! জাতিসংঘের যেন কিছুই করার নেই। আজ স্পষ্টতই যে, অর্থ ও বাণিজ্যের কাছে মানবতা, মানবিকতা, নারী ও শিশু অধিকার, মনুষত্ব্য, বিবেক, মানবাধিকার সব কিছু শেষ হয়ে যায়। রোহিঙ্গাদের নির্মূল চলছে তো চলছেই। তাহলে বিশ্বের মোড়ল বোধ হয় এখন অং সান সুচিই! এমন একজন মানুষের কাছে নোবেল প্রাইজ থাকলে এ প্রাইজের কি কোনো মর্যাদা থাকে?
বিশ্বের সর্বোচ্চ মানুষ গণহত্যাকারীর কাতারে আজ মিয়ানমার। মুদি, সুচি, বুশ, নেতানিয়াহু, কালিঙ্গা বেটল, মাও সেতুং, মুসলিনী, জোসেফ স্টালিন, হিটলার প্রমুখ। এর সঙ্গে মুসলিম নিধনের ক্ষেত্রে ইহুদি, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ ও হিন্দু বরাবরই ঐক্যবদ্ধ। দুঃখজনক হলেও সত্য, বহুদিন ধরেই বাংলাদেশের পরিক্ষিত বন্ধু বলে পরিচিত ভারত, চীন ও রাশিয়া আজ বাংলাদেশের জনমানুষকে ও বিশ্ববিবেককে বিস্মিত করে ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশকে কূটনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত ও একা করে দিয়েছে। বিশ্বের সমস্ত মিডিয়ায় সু চির মুসলমান নিধনকে ‘বৌদ্ধ সন্ত্রাসী’ বলে অভিহিত করলেও ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের পরম বন্ধু রাষ্ট্র ভারতও মিয়ানমারের গণহত্যার পক্ষ নিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ভারতের স্বাধীনতাকামীদের আন্দোলন দমন, কড়িডোর সুবিধা, ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কাছ থেকে পুরো সুবিধা আদায় করে আজ বিপদের সময় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এছাড়া ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থই বাংলাদেশের বন্ধু হয়েও রাশিয়া ও চীন জাতিসংঘে প্রকাশ্যে মিয়ানমারের পক্ষ নিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কোন স্বার্থে চীন-রাশিয়া বাংলাদেশ ও বিশ্বসম্প্রদায়কে পাশ কাটিয়ে জাতিসংঘে বারবার মিয়ানমারের সাফাই গেয়ে মানবাধিকারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বর্বর জাতিগত নিধনকেই বৈধতা দিচ্ছে? বিশ্বের উল্লেখযোগ্য সব দেশ, সংস্থাই যেখানে রোহিঙ্গাদের পাশে, সেখানে আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ভারত, চীন, রাশিয়ার অবস্থান দুর্ভাগ্যজনক। তারা মানবতার পাশে না থেকে কিছু স্বার্থের জন্য বিশ্ববাসীর কাছে নিজেদের অবস্থান উন্মোচিত করে ভবিষ্যতের ইতিহাস হয়ে থাকবে।
মিয়ানমারে ভারত নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে চাইছে। ফলে মিয়ানমারকে তারা কোনোভাবেই বিরক্ত করতে চাইবে না। কারণ বাংলাদেশকে তো কেনা হয়ে গেছে, মিয়ানমার বাকি আছে। ভারত, চীন, রাশিয়া বাংলাদেশের পাশে নাই এটুকুই শেষ নয়। বরং রোহিঙ্গারা যেন আর মিয়ানমারে ফিরে যেতে না পারে সেজন্যও ওরা বিভিন্ন ছলচাতুরি ও তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। চীন তার উইগুর প্রদেশে মুসলামানদের হত্যা, তিব্বত ও মুসলিম অধ্যুষ্যিত জিংজিয়াং বা পূর্ব তুর্কমেনিস্তান দখল করে রেখেছে। ভারত কাশ্মীরে। মিয়ানমার হত্যা, ধর্ষণ ও দেশান্তরি করছে রোহিঙ্গা মুসলিমদের। আজ এই ৩ খুনি এক কাতারে দাঁড়িয়েছে। কারণ চোরে চোরে মাসতুতো ভাই। অতীতে চীনের চেঙ্গিস খান, হালাকু খান, কুবলাই খান এরা সবাই মিলে ১৬ লক্ষ মুসলমানকে হত্যা করে ইরাককে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়। রাশিয়া এশিয়া মাইনর অঞ্চলের কোটি কোটি মুসলিমকে হত্যা করেছে।
ভারত, চীন ও রাশিয়ার আস্কারায় মিয়ানমারে সামরিক জান্তা অতীতের ৪ দশক ধরে চলা আন্তর্জাতিক অবরোধের থোড়াই কেয়ার করেছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর কাছে সকল ধরণের অস্ত্রের প্রায় একক বিক্রেতা চীন। অর্থাৎ চীনের তৈরি অস্ত্রই মিয়ানমার প্রতিরক্ষা খাতের প্রধান শক্তি। ১৯৮৮ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত কেবল চীনের কাছ থেকে ১৬৯ কোটি ডলারের অস্ত্র সামরিক ও সরঞ্জাম কিনেছে মিয়ানমার। অতএব এতবড় অস্ত্রের বাজার চীন কেন কেউই হাত ছাড়া করতে চাইবে না।
১৯৮৮ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার কাছ থেকে মিয়ানমার কমপক্ষে ৩৯ কোটি ৬০ লাখ ডলারের অস্ত্র ক্রয় করেছে। অস্ত্র রপ্তানির অবস্থান একচেটিয়া করতেই মরিয়া হয়ে উঠেছে রাশিয়া। এছাড়াও রাশিয়া মিয়ানমারে দুটি পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির চুক্তি রয়েছে যার কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। এ ছাড়া দেশটির বিপুল খনিজ সম্পদ (বিশেষত তেল, গ্যাস) আহরণে ইতোমধ্যে মিয়ানমারে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে।
আমেরিকা, ফ্রান্স, ব্রিটেন, চীন, রাশিয়া এই ৫টি দেশ নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। এর মধ্যে যে কোনো ৩টি দেশ একমত হয়ে অন্যায়কারী দেশের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদে তার ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে এ ধরনের জাতিগোষ্ঠী নিধনের ব্যবস্থা বন্ধ করতে না পারলে জাতিসংঘ ঠুঁটো জগন্নাথ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। এভাবে ভেটো ব্যবস্থা বজায় রাখলে বিশ্বের দেশে দেশে মানবতা ভূলুণ্ঠিত হবে তাতে জাতিগোষ্ঠী ও দেশ কীভাবে ন্যায়বিচার পাবে তা নতুন করে ভাবতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
সম্পাদনা: আশিক রহমান