‘ওজনদার’ লেখা ও ‘সিরিয়াস’ লেখক প্রসঙ্গে
কাকন রেজা
‘কী সব লিখছেন ভাই, একটু ভারী কিছু লিখেন, সিরিয়াস হন’, একটি কাগজে প্রকাশিত লেখা দেখে এমন মন্তব্য এক সুহৃদের। বয়সে ছোট ওই সুহৃদ, যথেষ্ট সিরিয়াস চরিত্রে এবং কাজে। বলাবাহুল্য সেও একজন গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট মানুষ, তাও আবার ছাপামাধ্যমের। সুতরাং ভাবতেই হয় নিজের লেখার ‘ওজন’ ও ‘সিরিয়াসনেস’ সম্পর্কে। আমার লেখা অনেকটা ‘স্যাটায়ার’ ঘরানার। সম্ভবত ‘স্যাটায়ার’ জাতীয় লেখার ‘ওজন’ খানিকটা কম এবং পড়ার সময় খুব করে মুখ গম্ভীর করে রাখা সম্ভব হয় না বলে ‘সিরিয়াসনেসে’রও ঘাটতি রয়েছে। সে অনুযায়ী সেই সুহৃদের অনুযোগটাও বেঠিক নয়।
তবে প্রশ্ন হলো, কী নিয়ে ভারী লেখা লিখি, কী নিয়ে সিরিয়াস হই। বিপন্ন মানুষের আশ্রয় ও আস্থার জায়গা হলো বিচারালয়। ইসলাম বলে, আল্লাহতায়ালা বিচারকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। বিচারকদের অবস্থান কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা এ কথাই প্রমাণ করে। সুতরাং এমন ওজনদার বিষয়ে লিখতে বা বলতে সিরিয়াস না হয়েও উপায় নেই। কিন্তু যে দেশে প্রকাশ্যে প্রধান বিচারপতি ‘তুই-তুমি’ সম্বোধনে সম্বোধিত হন, টানাহেঁচড়া চলে, সেখানে ‘ওজন’ আর ‘সিরিয়াস’ বিষয় দুটোর চর্চা করি কীভাবে! অনেকে বলবেন, পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে এমনটা হয়েছে। আমিও বলি, ঠিকই তো, আমার লেখাও তো পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনায় ‘কম ওজন’ ও ‘নিম সিরিয়াস’ হয়েছে। আর লেখাও তো কম হচ্ছে না। ‘সিরিয়াস’ আর ‘ওজনদার’ লেখক ও লেখার তো অভাব নেই। এত ‘ওজনদার’ লেখা ও ‘সিরিয়াস’ লেখকের ভীড়ে দু-একজন ‘কম ওজন’ ও ‘নিম সিরিয়াস’ লেখা ও লেখকের তো দরকার, না কী? এমনিতেই আমাদের দেশে ‘মাল্টিপল’ জিনিয়াসের অভাব নেই। বুঝলেন না, বুঝিয়ে বলি, সাধারণত জিনিয়াসরা বিশেষ বিষয়ে বিশষজ্ঞ হন, কিন্তু আমাদের জিনিয়াসরা সব বিষয়েই বিশেষজ্ঞ, একেবারে ‘মাল্টিপল’। (ভুল করে আবার কেউ ‘পল্টিপল’ পড়বেন না)।
সামাজিক মাধ্যমে একজন ‘রাইজিং’ গণামাধ্যম বিশারদের নারী নির্যাতন সম্পর্কিত একটি পোস্ট দেখলাম। সেখানে ‘নির্যাতন’ শব্দটিকে তিনি লিখেছেন ‘নির্জাতন’ এভাবে। অবশ্য নির্জনতার সঙ্গে নির্যাতনের একটি সম্পর্ক রয়েছে বলেই হয়তো এভাবে লেখা। অনেকটা ‘ইয়ে’ একাডেমি টাইপ পরিবর্তন বা সংশোধন। এমন বিশেষজ্ঞদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নির্জলা ‘স্ট্যাটাস’ কিংবা ‘রচনা’গুলিকে অনুসরণ করলেই বোঝা যায়, ‘ওজন’ আর ‘সিরিয়াসনেসে’র অবস্থাটা কী।
শিবের গীত বাদ। বিশেষজ্ঞ বিষয়ে আসি। আমাদের দেশে যেকোনো বিষয়ে দেখবেন সিরিয়াস লেখকের কোনো অভাব নেই। সবাই প্রমাণ করতে ব্যস্ত তারা সিরিয়াস লেখক, তাদের লেখা ডিজিটাল নিক্তির মাপে ওজনদার। কিন্তু ঝামেলাটা অন্যখানে, ধরুন ‘সংবিধান’ বিষয়ে গণমাধ্যমের কেউ একজন বা চিকিৎসক অথবা ব্যবসায়ী কিংবা হালের কোনো বুদ্ধিজীবী (?) যদি ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রফিকুল হকের মতোন কাউকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন, তাহলে অবস্থাটা কী দাঁড়ায়? সেই লেখাকে কী ‘ওজনদার’ এবং লেখককে কী ‘সিরিয়াস’ বলবেন? জানি না, কেউ কেউ বলতেও পারেন। দুটি শব্দ ‘মহামান্য’ ও ‘মাননীয়’, এ শব্দ দুটির ব্যবহারের গুরুত্ব ও ক্ষেত্র কী, তা জেনে বুঝে লেখা এবং বলা উচিত। তেমনি নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থানটাও লেখা ও বলার ক্ষেত্রে বোঝা উচিত। নির্দিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের দেওয়া মতামতের উপর আমাদের লজিকটা প্রকাশ করতে পারি, সংশয় বিষয়ে নোটিশ করতে পারি, জানতে চাইতে পারি, কিন্তু চ্যালেঞ্জ করতে হলে, তর্কে যেতে চাইলে ভাবতে হবে এবং বুঝতে হবে। ভাবা ও বোঝার হেরফেরের কারণে অনেক সময় কোনো ‘সিরিয়াস’ লেখকদের ‘ওজনদার’ লেখাও বাজারের চায়ের দোকানের ‘আড্ডালোচনা’র চেয়ে ‘নিম সিরিয়াস’ ও ‘কম ওজনদার’ হয়ে যায়। যারা লেখেন তারা হয়তো অতি ব্যস্ততার কারণে বুঝে উঠতে পারেন না, কিন্তু যারা বোঝার তারা কিন্তু ঠিকই বুঝে নেন।
ফুটনোট : একটি বহুল প্রচলিত ও প্রচারিত গল্প দিয়েই শেষ করছি। ‘শেয়াল প-িত গাধার সঙ্গে তর্ক বাধিয়েছে। বিতর্ক এতই জটিল হয়ে দাঁড়াল যে তারা দুজনেই বাধ্য হয়ে বনের রাজা সিংহের কাছে বিষয়টির ফয়সালা চাইল।
শেয়ালের যুক্তিটি ঠিক হলেও বিচারক হিসাবে সিংহরাজ শেয়ালকেই শাস্তি দিলেন।
শেয়াল বলল, রাজা, এ কেমন বিচার! যুক্তি ঠিক হওয়া সত্যেও আমিই শাস্তি পেলাম, সেল্যুকাস! বিচিত্র আপনার বিচার প্রক্রিয়া।
সিংহ বললেন, ওরে, আমি তোর যুক্তির জন্য তোকে শাস্তি দিইনি, তুই প-িত হয়েও গাধার সঙ্গে তর্কে গিয়েছিলি, সেজন্যই তোর এই শাস্তি।’
সুতরাং শাস্তি এড়িয়ে চলাই ভালো।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান