জীবনোৎসর্গের অর্ধ-শতাব্দী পরও চে গুয়েভারা কেন এতটা জনপ্রিয়?
মোহাম্মদ আলী বোখারী, টরন্টো থেকে :
বিষয়টা হতবাক করার মতো যে, চে গুয়েভারা নিজের জীবনোৎসর্গের অর্ধ-শতাব্দী পরও পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় মহানায়কের মতোই বেঁচে আছেন। যেন যিশুখ্রিস্টের আদলে এক বিপ্লবী প্রতিকৃতি সব জাতিসত্তায় বিমূর্ত। প্রতিবেশী ভারতের দৈনিক দ্য হিন্দু, ইন্ডিয়া টুডে ও হিন্দুস্তান টাইমস, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্ট ও এবিসি নিউজ, যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান ও বিবিসি, রাশিয়ার আরটি, গণচীনের চায়না ডেইলি, ফ্রান্সের প্রেস শ্যালে ও ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর, মধ্যপ্রাচ্যের আল জাজিরা, ফিলিপাইনের ইনকোয়রার, মালয়েশিয়ার মালয়েশিয়ান ইনসাইট,
পাকিস্তানের ডেইলি টাইমস ও জিও টিভি, তুরস্কের হুরিয়েত ডেইল নিউজ, সিরিয়ার সিরিয়া টাইমস, আর্জেন্টিনার ল্যাটিন আমেরিকান নিউজ এজেন্সি এবং কিউবার গ্র্যানমায় এই বিপ্লবী নেতার ৫০তম মৃত্যুবার্ষিকীর সংবাদ, প্রতিবেদন ও নিবন্ধ প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। এ সকল ইংরেজি গণমাধ্যমের পাশাপাশি আয়ারল্যান্ড সরকার তার প্রতিকৃতি সংবলিত স্মারক স্ট্যাম্প প্রকাশ করেছে। আর যে বলিভিয়ায় তাকে জীবনোৎসর্গ করতে হয়েছে, সেখানে স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস রাষ্ট্রীয়ভাবে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে গিয়ে বলেছেন, আজ চে’র আদর্শে বিশ্বে আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরুর পরিপূর্ণ দিন। অন্যদিকে, চে যে কিউবায় বাতিস্তা সরকারের পতনে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সঙ্গী হয়ে লড়েছেন, সেখানকার রাজধানী হাভানার নিকটবর্তী সান্তা ক্লারায় ছবি হাতের লাখো মানুষকে নেতৃত্বদানপূর্বক শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেছেন প্রেসিডেন্ট রাহুল ক্যাস্ট্রো। তাতে নিদ্বির্ধায় বলা যায়, অমর এক বিপ্লবী আজো তার আদর্শের তেজস্বী চেতনায় প্রত্যয়দীপ্ত এবং অকুতোভয় সংগ্রামের আবাহনে চিরজাগরুক।
কিন্তু কেন? কারণ, তার জীবনের শেষ কথা ছিল ‘গুলি কোরো না। আমি চে গুয়েভারা। মৃত চে গুয়েভারার চেয়ে জীবিত চে গুয়েভারা তোমাদের বেশি প্রয়োজন’। গত মঙ্গলবার ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় এ বিষয়ে ক্রিস্টিন ফিলিপ্সের নিবন্ধ ‘ডু নট শ্যুট! দ্য লাস্ট মোমেন্টস অব কমিউনিস্ট রেভল্যুশনারি চে গুয়েভারা’ শীর্ষক নিবন্ধে বিশদ প্রকাশ পেয়েছে। তবে সেটির শেষাংশে বলা হয়েছে যে, মৃত্যুর ৫০ বছর পর গুয়েভারা ‘আইকন’ বা প্রতিমাতুল্য হয়েছেন, তার জীবন ও মৃত্যু রোমাঞ্চিত হয়েছে। যে জঙ্গলে তিনি আহত অবস্থায় ধরা পড়েছেন এবং যে স্কুলঘরটিতে তাকে হত্যা করা হয়েছিল, তা পর্যটক আকর্ষণের স্থানে পরিণত হয়েছে। যে ‘লন্ড্রিসিঙ্ক’ বা কাপড় ধোয়ার চৌবাচ্চায় তার মৃতদেহটি রাখা হয়েছিল, তা হয়েছে স্মৃতিসৌধ। তার একটি বিশাল মূর্তি রয়েছে লা হিগেরায় (ভেলগ্রান্দে প্রদেশ, বলিভিয়া)। পাদদেশে লেখা রয়েছে ‘ইওর এক্জাম্পল লাইটস এ নিউ ডন’ অর্থাৎ তোমার আদর্শ নতুন প্রভাতের আলোকচ্ছটা ছড়িয়েছে। তাই গুয়েভারার মুখম-ল, ঘন কালো চুল, অপরিপাটি দাঁড়ি এবং সামরিক বাহিনীর চ্যাপ্টাটুপি সংবলিত প্রতিকৃতিটি পরিধানের টি-সার্ট, দেয়ালে ও ব্যানারে দৃশ্যমান। নিউ ইয়র্কার পত্রিকার লেখক ও জীবনী রচয়িতা জন লি অ্যান্ডারসন গুয়েভারার জীবনীতে লিখেছেন, তিনি ক্যারিশমাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, হতচ্ছড়া, শান্ত ও মেজাজি। ভয়হীন নেতা, যিনি ত্রিশোর্ধ্ব বয়সে পরিবার ছেড়েছেন না ফেরার নিশ্চয়তায়। তিনি যা করেছেন, তা সাধারণের পক্ষে অসম্ভব। মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে ‘যিশুসাদৃশ্য এই মানুষটিকে কী করে নিজের মতো করে আপনি ভাবেন’?
এতে জন লি অ্যান্ডারসনের ওই প্রশ্নপূর্ণ ভাবনায় নিজেও ভেবে দেখেছি, কী করে যৌবন থেকে এই মধ্য বয়সে এসেও অমলিন দৃষ্টিতে তার প্রতিকৃতিটি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখি; যেন এক প্রাণচঞ্চল বিপ্লবী অস্ফুট দৃষ্টিতে কোনো কিছুর জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন। যদি সেটা বিপ্লবের আদর্শ হয়, নিশ্চয়ই তা ফুরিয়ে যায়নি। সম্ভবত ওই উপলব্ধি থেকেই চে গুয়েভারার ৫০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আয়ারল্যান্ড তাদের মন্ত্রিপরিষদের নিয়মতান্ত্রিক অনুমোদনে এক ইউরো মূল্যের একটি স্ট্যাম্প প্রকাশ করেছে, যা ডাবলিনের শিল্পী জিম ফিটজপ্যাট্রিক এঁকেছেন। তবে মার্কিন-কিউবান সাংবাদিক নিনোস্কা পেরেজের মতে, গুয়েভারার মতো গণহত্যাকারীকে এমন সম্মান দেওয়াটা ঠিক হয়নি। প্রশ্ন হচ্ছে, চে গুয়েভারার বিশ্বময় অপ্রতিরোধ্য জনপ্রিয়তায় সেই মতামত কি কোনো অন্তরায় হতে পারবে?
ই-মেইল : [email protected]