সকল মুমিন একটা দেহের ন্যায়
শোয়াইব মনজুর
আরাকানে শতো বছরের মুসলিমদগ্ধ আগুন আবার দাউ দাউ করে ছড়িয়ে পড়লো চরমভাবে। পুড়লো মা, ভস্ম হলো শিশু, জ¦ললো ভিটেবাড়ি, শোষিত হলো মুসলমান। কেবল মুসলমান হওয়াটাই যেনো তাদের বড় অপরাধ। ফলে শতো নির্যাতনের শিকার হলো তারা। জ¦লন্ত আরাকানের কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে গেলো বিশে^র আকাশ। নিপীড়িত আরাকানি মুসলমানের আর্তনাদে ভারী হলো অশান্তির বাতাস। কেবল প্রাণের শেষ রক্ষার্থেই মাতৃভূমি থেকে লুকিয়ে হিজরতের চেষ্টা বাংলাদেশে। তাতে আবার দেহ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো সীমান্তে পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে। আবার নৌকোডুবিতে অনেকের দেহ লাশ হয়ে ভেসে গেলো খর¯্রােতা নাফনদে। অনেকের বা প্রাণের শেষ রক্ষে হলো কোনোমতে। পৌঁছুলো তারা বাংলাদেশে। যাদের সংখ্যা সাড়ে চার লাখ প্রায়। সর্বহারা, সর্বশান্ত এই রোহিঙ্গা মুহাজির আমাদের ভাই। কারণ তারা মুসলমান। ইরশাদ হচ্ছেÑ‘মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। তাই তোমরা ভাইদের মাঝে শান্তি স্থাপন করো এবং আল্লাহকে ভয় করো।
যেনো তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হতে পারো।’ (সুরা হুজুরাত : ১০)। তাই অশান্তিতে নিপতিত দুর্দশাগ্রস্থ যে সকল রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে শরণার্থী হয়ে এসেছে, তাদের মাঝে শান্তি স্থাপনের দায়িত্ব আমাদের। ভ্রাতৃত্বের টানেই পাশে দাঁড়াতে হবে আমাদেরই। যে ভ্রাতৃত্বের ঘোষণা রাসুলে কারিম (সা.) দিয়ে গেছেনÑ‘প্রত্যেক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই।’ (রিয়াদুস সালিহিন : ২৪৪)। যেই ভ্রাতৃত্বের আদর্শ ফুটে উঠেছে মদিনার সাহাবিদের পক্ষ থেকে উদার আচরণের মাধ্যমে মক্কার মুহাজির সাহাবিদের প্রতি। মুহাজিরদের প্রতি তাদের সাহায্য-সহযোগিতার মাঝে ভ্রাতৃত্ব ও আন্তরিকতার অতি প্রকাশ ঘটেছিলো। ফলে তারা ‘আনসার’ তথা সাহায্যকারী নামে পরিচিতি পান। লাভ করেন বহু ফজিলত। আজ আমরা বাংলাদেশি মুসলমান সেই আনসারদের ভূমিকায়।
রোহিঙ্গা মুহাজির ভাইদের প্রতি আমাদের সাহায্য-সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করতে হবে মদিনার সেই আনসার সাহাবিদের মতোই। যেমনিভাবে মক্কা বিজয় ও সেখানে মুহাজিরদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবার আগ অবধি আনসারগণের প্রতিটি রুটি ও খেজুরে মুহাজিরদেরকে অংশ দেয়া হয়েছিলো, ঠিক তেমনি মায়ানমারের ভূমিতে রোহিঙ্গা মুসলমানদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবার আগপর্যন্ত আমাদের নিত্য জীবনোপকরণে তাদের অংশ রাখা চাই। আমাদের সরকার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছেন। দিয়েছেন সাহায্য-সহযোগিতার আশ^াস। কিন্তু যদি রোহিঙ্গাদের স্বদেশে নিরাপত্তা নিশ্চিত হতে বেশ কিছুদিন সময় লেগে যায়, আর তাদের ব্যাপারে আমরা সরকারকে কোনো সহযোগিতা না করি, তাহলে হয়তো একসময় চাপের মুখে সরকার বাধ্য হবে তাদেরকে নিরাপত্তাহীন, অনিশ্চিত জীবনের দিকে ঠেলে দিতে। ‘সরকারের শক্তির উৎস জনগণ।’ এ কথা মাথায় রেখে কেবল এককালীন কিছু করে ক্ষ্যান্ত হলে চলবে না, অব্যাহত রাখতে হবে সহযোগিতার ধারা। রাসুলে কারিম (সা.) ইরশাদ করেনÑ‘সকল মুমিন একটা দেহের ন্যায়। চোখে বা মাথায় আঘাত লাগার ফলে যেমন সমস্ত শরীর ব্যথিত ও ভারাক্রান্ত হয়, ঠিক তেমনি এক মুসলমানের বিপদে সকল মুসলমানেরই ব্যথিত হওয়া অনিবার্য।’ (সহিহ মুসলিম : ২৫৮৬, মুসনাদে আহমদ : ২২৩৭০)।
যেমনিভাবে কোনো অঙ্গে ক্ষত হলে সে ক্ষত পূর্ণরূপে সুস্থ হয়ে ওঠা পর্যন্ত আমরা তার চিকিৎসায় সচেষ্ট ও যতœবান থাকি, ঠিক তেমনি হাদিসের ভাষ্যানুযায়ী আমাদেরই একটা অঙ্গ মুসলিম রোহিঙ্গাগোষ্ঠী। আজ তারা ব্যথিত, ক্ষতবিক্ষত। তাদের খাদ্য-বস্ত্র, চিকিৎসা ও বাসস্থানের সুব্যবস্থার প্রতি যতœবান হওয়া আমাদের ওপরই অনিবার্য। তাদের প্রতি আমাদের এ দায়িত্ব মানবিকতার, এ বোধ ভ্রাতৃত্বের, সর্বোপরি ইমান ও আল্লাহভীরুতার।
লেখক : শিক্ষার্থী, গওহরডাঙ্গা মাদরাসা, টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ।