শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী সা.
আহমদ আবদুল্লাহ
আজকের শিশু আগামী দিনের স্বপ্নিল সম্ভাবনা। শিশুর সুষ্ঠু বিকাশের ওপর নির্ভর করে একটি সুস্থ জাতির গঠন। সে কারণে শিশুর জীবনের অধিকার, নিরাপত্তা, সুস্থ বিকাশ অপরিহার্য। মহানবী (সা.)- এর আবির্ভাবের পূর্বের সময়টাকে আইয়ামে জাহেলিয়া বা অজ্ঞতার যুগ বলা হয়। গোটা সমাজ তখন সবধরণের পাপ ও অন্যায়ের অন্ধকারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিলো। কোথাও কারো কোনো অধিকার, নিরাপত্তা বিদ্যমান ছিলো না। ছিলো না জীবনের নিশ্চয়তা। জন্মের পর শিশুরা যেহেতু অসহায়, তাই তাদের জীবন-মরণ নির্ভর করত মা-বাবা বা সমাজপতিদের ওপর। কন্যা সন্তান হওয়া অশুভ অকল্যাণ মনে করে জীবিত পুঁতে ফেলা হতো। অপরদিকে পুত্র-সন্তান এবং বর্বরতার হাত থেকে বেঁচে যাওয়া কন্যা সন্তানেরা সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার পরিবেশ পেতো না। তারা বেড়ে ওঠতো অনাদারে, অবহেলায়, অশিক্ষায়, কুশিক্ষায় ও অবাঞ্ছিত মানবরূপে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিশুরা তাদের মা-বাবার আদর-সোহাগ থেকে বঞ্চিত হতো।
আরবের এহেন নাজুক অবস্থাতে মহানবী (সা.) শিশুদের পাশে দাঁড়ান। পৃথিবীতে সর্বপ্রথম শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। আরব সমাজ হতে শিশু হত্যা রোধ এবং তাদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। তাদের সুস্থ ও পরিপূর্ণ বিকাশের মাধ্যমে আদর্শ জাতি, সমাজ, রাষ্ট্রগঠনের ভিত তৈরি করেন।শিশুরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ। আরব সমাজে চরম অবহেলিত ও নির্যাতিত শিশুদের তিনি সেরা সম্পদ বলে আখ্যায়িত করেন। তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন করেন। পবিত্র কুরআন মহান রাব্বুল আলামিন বলেন, ধনৈশ্বর্য এবং সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য। ( সুরা কাহাফ: ৪৬)
শিশুর সুস্থ ও সুন্দর বিকাশ অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে রাসুল (সা.) জোর তাগিদ দিয়েছেন। তাদের প্রতি যথাযথ আদর, স্নেহ, মায়া মমতা প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছেন। মহানবী (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি ছোটদের স্নেহ করে না, বড়দের সম্মান করে না সে আমার দলভুক্ত নয়। অন্যত্র বলেন, শিশুদের স্নেহ করো এবং তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করো। তোমরা তাদের সঙ্গে ওয়াদা করলে তা পূর্ণ করো। কেননা, তাদের দৃষ্টিতে তোমরাই তাদের রিজিকের ব্যবস্থা করছো। অপর এক হাদিসে হজরত আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) তাঁর নাতি হাসানকে চুমু খেলেন। সেখানে আকবা ইবনে হাবিস নামে এক সাহাবী বসা ছিলেন। হাসানকে চুমু খাওয়া দেখে তিনি বললেন, আমার দশটি সন্তান রয়েছে। আমি তাদের কাউকে চুমু খাইনি। নবীজী তার দিকে তাকিয়ে বললেন, যে দয়া করে না, তার প্রতিও দয়া করা হবে না। (সহীহ বুখারী: ৫৬৫১) তাই শিশুদের আদর করা, তাদের চুমু খাওয়া নবীজির শিক্ষা, নবীজির চাওয়া।ইসলাম শিক্ষার ব্যাপারে অত্যধিক গুরুত্বারোপ করেছে। মহান আল্লাহ আমাদের শিক্ষার আলো স্বরূপ মহাগ্রন্থ আল কুরআন নাযিল করেছেন। কুরআন নাযিলের প্রথম শব্দই ছিল ‘ইক্বরা’ অর্থ পড়। শিক্ষা ব্যতীত কোন জাতির উন্নতি কল্পনা করা যায় না। জাগতিক ও পারলৌকিক উভয় জগতের উন্নতি, অগ্রগতি ও সফলতার জন্য শিক্ষা একান্ত প্রয়োজন। তবে অবশ্যই ইসলামী নৈতিকতা ও আদর্শভিত্তিক শিক্ষা হতে হবে। শিক্ষা এমন এক আলো যা অজ্ঞতা ও অন্ধকারকে দূরীভূত করে, মানুষকে কল্যাণ ও সমৃদ্ধির পথ দেখায়। শৈশবকাল থেকেই পিতা-মাতা ও অভিভাবককে শিশুদের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারে সচেতন ও যতœবান হতে হবে। রাসুল (সা.) বলেন, তোমরা নিজেদের সন্তানদের স্নেহ করো এবং তাদের শিষ্টাচার শিক্ষাদান করো। তিনি আরও বলেন, তোমরা তোমাদের সন্তানদের প্রতি দৃষ্টি রাখো। শিশুদের উত্তম ও যুগোপযোগী শিক্ষাদানের জন্য রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমাদের সন্তানদের উত্তমরূপে জ্ঞানদান করো কেননা, তারা তোমাদের পরবর্তী যুগের জন্য সৃষ্টি।’ সুতরাং বর্তমান বিশ্বে নেতৃত্বের জন্য শিশুকে সময়ের চাহিদানুযায়ী আধুনিক ও ধর্মীয় শিক্ষা-দীক্ষায় গড়ে তুলতে হবে।
রাসুল (সা.) শিশুদের সীমাহীন ভালোবাসতেন। তাদের আগে সালাম দিতেন। শিশুদের কান্না তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না। একবার তিনি শিশু হুসাইনের কান্নার আওয়াজ পেলেন। এতে তিনি ব্যথিত হলেন এবং হজরত ফাতেমা (রা.) কে বললেন, তুমি কি জানো না, শিশুদের কান্নার আওয়াজ আমাকে কষ্ট দেয়?
মহানবী (সা.)- এর শিশুপ্রীতি, তাদের প্রতি দয়া ও মমতার দিকটা ফুটে ওঠে এমন আরও অসংখ্য হাদিসে। মানবতার মুক্তি দূত বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.) কর্তৃক শিশুদের অধিকারের বিষয়টি পর্যালোচনা করলে এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, শিশুর অধিকার, মর্যাদা, সুষ্ঠু বিকাশ ও সুশিক্ষা সম্পর্কে তিনিই সর্বপ্রথম এগিয়ে আসেন। নিজের জীবদ্দশায় তিনি শিশু অধিকার ও সামাজিক অবস্থান সুনিশ্চিত করেন। সুতরাং তারই প্রদর্শিত ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থায় একটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক সুস্থ বিকাশ সম্ভব।
লেখক: শিক্ষক, মাদরাসা বাইতুন নূর ঢাকা।