‘কী করিলে কী হয়’!
দীপক চৌধুরী
গুজবের শেষ নেই। গত কয়েকমাস ধরেই চলছে গুজব, দেশ নিয়ে, দেশের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে, ক্ষমতা নিয়ে। এই গুজবের হেতু কী এর স্পষ্ট জবাব নেই। প্রধান বিচারপতির কর্মকা-কে কেন্দ্র করেই তুলকালাম কা- আর কী। শুক্রবার রাতে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। বিদেশ যাওয়ার আগে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমি সুস্থ’, আমি ভালো আছি, আমি একটু বিব্রত।’ হঠাৎ করে তার এমন উচ্চারণে আবার কেউ কেউ ‘পলিটিক্যাল গসিপ’ তো জানেন, আবশ্যই জানেন, রাজনীতিতে শেষ কথা যেমন নেই, বিচার বিভাগে তেমনি শেষ কথা আছে। আমাদের দেশের জন্ম ইতিহাস, সৃষ্টি, স্বাধীন সার্বভৌম হয়ে ওঠার পেছনে মূলশক্তি কিন্তু বিচারালয় ছিল না, ছিল জনগণ। আমরা সবাই জানি জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। আর এজন্যেই ১৯৭১-এ জনযুদ্ধ হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। কোনো বিচারপতির নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার আগে বঙ্গবন্ধুর ডাক, তার ভাষণ ও নির্দেশনা ছিল। এরপর দীর্ঘ সংগ্রাম, রক্তক্ষয়, ত্যাগ-তিতিক্ষা, ত্রিশ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময় ও দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। সংবিধান হয়েছে। সার্বভৌম সংসদ হয়েছে। হয়তোবা জাতির পিতার একক প্রচেষ্টায় দেশ স্বাধীন হয়নি কিন্তু যার একক উদ্যোগ, প্রেরণা এবং সাংগঠনিক শক্তি এর নেপথ্যে ছিল তিনিই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এটাতো স্বীকার করতেই হবে। কোনো ধর্মের বা জাতির নেতা, প্রবক্তা, নির্দেশদাতা একজনই হয়, দুজন নয়।
কে না জানে, পাকিস্তানি বাহিনী ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালি জাতির ওপর আক্রমণ চালানোর পরপরই জাতির পিতা স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। পাকিস্তানিরা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে জাতির পিতার বাড়িতে আক্রমণ করে এবং তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। শুধু তাই নয়, ইতিহাস থেকে আমরা পাই, ২৬ মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দেন সেখানে বঙ্গবন্ধুর নাম বলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকেই দোষারোপ করেন, দায়ী করেন। ইয়াহিয়া খান তার ভাষণে আর কারও নাম বলেননি বা কাউকে দোষারোপ করেননি, দায়ী করেননি। জিয়াউর রহমানতো তার (ইয়াহিয়া) চাকরি করতেন। তখন তিনি সেনাবাহিনীর একজন মেজর ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় এবং প্রহসনের বিচার করে ফাঁসির রায়ে সই পর্যন্ত করা হয়েছিল। কারণ বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। অথচ দেশের জন্মদাতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় ১৯৭৫-এ। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত ২১টি বছর বঙ্গবন্ধুর নামটি মুছে ফেলার অপচেষ্টা চালানো হয়। জঙ্গি শাসকরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর বিচার বন্ধ করে দিল। কোথায় কোনো বিচারক তো সেদিন এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করেননি। সংসদে ইনডেমনিটি আইন নিয়ে বিতর্ক হয়, কথা হয় শেখ হাসিনা সংসদ নেতা হওয়ার পর। জনগণের সেই সংসদই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ খুলে দেয়।
এখন নানারকম প্রশ্ন সম্মুখে। চায়ের কাপে আড্ডার সঙ্গে একাধিক জিজ্ঞাসা যোগ হয়েছেÑ প্রধান বিচারপতির কোন কথাটি সত্য? তিনি একবার বলেছেন, আমি ক্যান্সারে আক্রান্ত। আবার বিদেশ যাওয়ার আগে বলেছেন, আমি সম্পূর্ণ সুস্থ। বিতর্কের শুরু থেকেই বিএনপির অভিযোগ, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের কারণেই চাপ দিয়ে প্রধান বিচারপতিকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। তবে ওই অভিযোগ অস্বীকার করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিচারপতি সিনহার স্বাক্ষরে রাষ্ট্রপতিকে পাঠানো ছুটির চিঠি গত ৪ অক্টোবর সাংবাদিকদের দেখান। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রধান বিচারপতি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে এর আগে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন এবং গত বেশ কিছুদিন ধরেও বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন।
প্রধান বিচারপতির বিদেশ যাবার পরই নানাকাহিনী গুজব ছড়াচ্ছে। গুজবের ডালপালা চারদিকে। কেউ বলছেনÑ তিনি সহসা ফিরবেন না। ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিই সব এখন। আওয়ামী লীগ ঈপ্সিত লক্ষে পৌঁছাতে তাদের কাজটি করিয়ে নেবে। আবার কেউ কেউ বলছেন, তিনি বহির্বিশ্বের ক্ষমতাধর নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দেশে ফিরবেন। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা এবং ইউনাইটেড কিংডম- এই চারটি দেশে যেতে চান বলেছিলেন। হাঁটু শক্ত করেই মাঠে নামবেন। এতে রাজনীতিও থাকবে, শুধু বিচার বিভাগ নয়। তবে আমজনতা অপেক্ষায় আছে, কে কী কাজ করিয়ে নেবে এটা সময়ই বলে দেবে। বীরের জাতি কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা করে না, প্রকৃতির সঙ্গে লড়ার সাহস রাখে বলেই এ জাতি ‘লড়াকু’। লড়াকু জাতি হতাশ হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবে না। এর চরিত্র ভিন্ন। বাঙালি কিন্তু ভীষণ রাগী-জেদি।
আগস্টের শুরুতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর থেকেই ক্ষমতাসীনদের সমালোচনার মুখে রয়েছেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফেরাতে আনা হয়েছিল সংবিধানের ওই সংশোধনীতে। তা বাতিল করে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনে সুপ্রিম কোর্ট। ১ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কাছে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা এক মাসের ছুটির কথা জানিয়ে চিঠি দেন। এখন তার ছুটি নয় দিন বাড়িয়ে ১০ নভেম্বর করা হয়েছে। ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পাওয়া বিচারপতি সিনহার চাকরির মেয়াদ রয়েছে আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। সুপ্রিম কোর্টের অবকাশ শুরুর আগে গত ২৪ আগস্ট তিনি শেষ অফিস করেন এবং অবকাশ শেষে ৩ অক্টোবর আদালত খোলার দিন থেকে তিনি ছুটিতে আছেন। অন্যদিকে সংসদের বাইরে থাকা বিএনপির নেতারা স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, এ রায় ‘ঐতিহাসিক’। বাজিকরদের কীর্তি-কা- থেকে সাবধান ও সতর্ক থাকতে হবে।
এদেশে নানারকম খেলা হয়েছে অতীতে। যেসব খেলার সঙ্গে কোনোভাবেই সাধারণ মানুষ জড়িত নয়। কিন্তু এদেশে খুনি শাসক হয়েছে, কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, উপদেষ্টা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের পুরস্কৃত করার এই পুরস্কারের খেলা এদেশের মানুষ বহুবার দেখেছি। কেউ কেউ খুনিদের দিয়ে দল গঠন করিয়েছে। জিয়াউর রহমান এদের কাউকে প্রধানমন্ত্রী, কাউকে মন্ত্রী, উপদেষ্টা করেছিলেন। জেনারেল এরশাদ খুনি রশিদ-ফারুককে দিয়ে ফ্রিডম পার্টি তৈরি করে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করেছিলেন। আর খালেদা জিয়া ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচন করে ওই খুনি রশিদ আর মেজর হুদাকে সংসদ সদস্য করে বিরোধী দলের চেয়ারে বসিয়েছিল। এই চিহ্নিত খুনিরাই এসব রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতার সঙ্গী হয়েছিল।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গল্পকার
সম্পাদনা: আশিক রহমান