বিচারিক স্বাধীনতা : উগা-া বনাম বাংলাদেশ
একটি জাতীয় পত্রিকায় ‘গরুর গাড়ির হেড লাইট’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় দেখে আমি মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। কারণ হেড লাইটের ‘হেড’ শব্দটির প্রতি আমার যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে ছাত্র জীবন থেকেই। কারণ ‘হেড’ হওয়ার মজাই আলাদা। যেমনÑ হেড মাস্টার, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধান প্রভৃতি। নারায়ণগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয়ের হেড মাস্টার মীর মোয়াজ্জেম আলী একটি বেত নিয়ে স্কুলের বারান্দা দিয়ে যখন এক পাশ থেকে আর এক পাশে হাঁটা-হাঁটি করতেন, তখন স্কুল মাঠে বা আনাচে-কানাচে দপ্তরি নিরোধকে পেছনে পেছনে হাঁটতে দেখা ছাড়া আর কাউকে দেখা যেত না। ক্লাস বন্ধ থাকলেও সবাই দৌড়ে ক্লাসরুমে চলে যেত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনে যিনি বিভাগীয় প্রধান ছিলেন তিনিই সে সময়ে আমার কাছে শ্রেষ্ঠ মানুষ বলে মনে হতো। ফলে তখন থেকেই ‘হেড’ শব্দটির প্রতি আমার ঝোঁক শুরু। তবে সে সময়ে উপলব্ধি করতে পারিনি যে, গরুর গাড়িরও ‘হেড লাইট’ থাকতে পারে। হেড (ঐবধফ) এর বাংলা শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘প্রধান’। ইংরেজিতে ক্ষেত্র বিশেষ যা আবার ‘ঈযরবভ’ হিসাবে ব্যবহার হয়। যেমন- ঈযরবভ ঔঁংঃরপব, অৎসু ঈযরবভ, ঈযরবভ ঈড়হংঃধনষব প্রভৃতি।
‘ঈযরবভ’ হওয়ার পেছনে স্বাচ্ছন্দ যেমন আছে, তেমনি বিড়ম্বনাও কম নয়। যেমন- উগা-ার প্রেসিডেন্ট ইদি আমিনের নির্দেশ মোতাবেক রায় না দেওয়ায় ৪ দিন পর সে দেশের প্রধান বিচারপতির লাশ একটি ড্রেনে পাওয়া যায়। অটোম্যান সাম্রাজ্যের অধিপতি সুলতান সোলায়মান খানের বাল্যবন্ধু ও বিশ্বস্ত সেনাপতি ইব্রাহিমকে ঘুমের মধ্যে ফাঁসি দিলেন তিনি নিজেই। তবে বাংলাদেশের অবস্থা এখনো সে পর্যন্ত গড়ায়নি। ইদি আমিন বা সুলতান সোলায়মানের মত ঘটনা ঘটালে কথিত ‘আইনের শাসন’ বা ‘অবাধ গণতন্ত্রের’ উপরে যদি কালিমা পড়ে যায় (!) এটা আমার নিছক ধারনা, তবে তা কতটুকু গড়াবে তা এখনো আঁচ করা যাচ্ছে না।
কথাগুলো লেখছিলাম ষোড়শ সংশোধনী ও বিচারপতি এস কে সিনহার ঘটনাবলি নিয়ে। এস কে সিনহা যে দিন প্রধান বিচারপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেছেন পরম্পরা মোতাবেক তার সংবর্ধনা বক্তিতায় অ্যাটর্নি জেনারেল সিনিয়ার অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম বলেছিলেন, ‘বিচারপতি এস কে সিনহার প্রধান বিচারপতি হিসাবে শপথের মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলো।’ বিভিন্ন টক শোতে সরকার ঘরানার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বিচারপতি সিনহার গুণ কীর্তণে মগ্ন ছিলেন তো বটেই, পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষণতা ও সাহসী সিদ্ধান্তের প্রতি জানিয়েছিলেন শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো একটি মাত্র রায়ে, যে রায় দেওয়ার পর বিচারপতি সিনহার ক্যান্সার ধরা পড়ার আগেই প্রকাশ পেল, তিনি ছিলেন রাজাকার সমর্থিত শান্তি কমিটির সদস্য এবং তার অবৈধ কোটি কোটি টাকা ও সম্পদের সন্ধানসহ প্রধান বিচারপতি হলেন তুলোধুনোর বস্তু। বিষয়টি হলো প্রধান বিচারপতির প্রতি সরকারের যে আচরণ দৃশ্যমান হলো তাতে কে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলো? ব্যক্তি সিনহা না বিচার বিভাগ?
বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের তিন বিভাগের মধ্যে একটি স্বতন্ত্র বিভাগ হওয়া স্বত্ত্বেও একটি রায়কে কেন্দ্র করে প্রধান বিচারপতিকে সরকার কর্তৃক এ ধরনের হেনস্তা হতে হবে কেন? এ হেনস্তার জন্য সরকার বিরোধী আইনজীবীরা সোচ্চার হলেও, ‘স্বাধীন বিচার বিভাগ’ নিরব দর্শকের ভূমিকায়। অ্যাপিলেট ডিভিশনের পূর্ণাঙ্গ ব্যাঞ্চ কর্তৃক সর্বসম্মতিক্রমে ০৩-৭-১৭ ইং প্রদত্ত এক রায়ে সংবিধান মোতাবেক বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সম্পর্কে যে মতামত ব্যক্ত করেছেন।
সরকার অনির্বাচিত এটাই তাদের আতঙ্ক। শোনা যাচ্ছে, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়েই ১৫৪ জন এমপিকে অবৈধ ঘোষণার বীজ বপন করা হয়েছিল। সে ধারাবাহিকতায় প্রধান বিচারপতি ১৫৪ জন এমপিকে অবৈধ ঘোষণার আতঙ্কে প্রধান বিচারপতির ছুটি নিয়ে যে নাটকের সৃষ্টি করলেন, তার যবনিকা টানতে প্রধানমন্ত্রী কতটুকু কৌশলী হচ্ছেন এটাই এখন দেখার বিষয়।
প্রধান বিচারপতি হয়তো একদিন মুখ খুলবেন। কিন্তু ইতোমধ্যে অনেকেই মুখ খোলেছেন। সরকারি ঘরানার আইনজীবী ও হিন্দু কমিউনিটি নেতা রানাদাস গুপ্ত প্রধান বিচারপতির সঙ্গে মন্দিরে সময় কাটিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, ‘জনাব সিনহাকে অসুস্থ্য মনে হয়নি।’ ভারতীয় চ্যানেল জি নাইন বলেছে, মাইনরিটি কমিউনিটি বলেই প্রধান বিচারপতিকে এ ভাবে হেনস্তা করা হলো। প্রচার বা অপপ্রচার যাই হোক না কেন, সাধারণ জনগণ মনে করেন, ছুটির দরখাস্তে মি. সিনহা স্বাক্ষর করেননি বা তাকে জোর করে স্বাক্ষর করানো হয়েছে। সরকার বিষয়টির সত্যতা নিয়ে জনগণের মনে আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। জনশ্রুতি রয়েছে, সময়ে সময়ে যাদের ব্যবহার করে বঙ্গভবনে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে, তারাই ছুটি দরখাস্তের নাটক মঞ্চস্ত করেছেন। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য জাতিকে আরও অপেক্ষা করতে হবে, তবে ইতোমধ্যে আরও নাটক বা ঘটনা-অঘটনা মঞ্চস্থ হয় কিনা তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার পূর্ব ও পরে প্রধান বিচারপতি তো বটেই কোনো বিচারপতিকেও এধরনের অসস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। বিচারপতি সিনহা প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণ করার পর তার অনেক সিদ্ধান্তে দেশের মানুষ গণতান্ত্রিক অধিকার হারিয়েছে, দুদক ও পুলিশের ক্ষমতা বৃদ্ধি হয়েছে। লাভবান হয়েছে সরকার, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গণতান্ত্রিক আন্দোলনরত বিরোধী দল। তার প্রভাবে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১ক ধারায় প্রদত্ত হাইকোর্টের ক্ষমতা সংকুচিত হয়েছে। অ্যান্টিসিপেটরি জামিনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। হাইকোর্টের দেওয়া প্রথিতযশা রাজনীতিবিদদের জামিন স্থগিত হয়েছে, সবকিছুতেই তিনি প্রভাব বিস্তার করেছেন। তারপরও জনাব সিনহার প্রতি সরকারের এ ক্ষোভ অনেক অর্থ বহন করে, যা মোটা দাগে উপলব্ধি করার কথা নয়।
সরকারের বক্তব্যে মনে হয়, দেশে এখন স্বর্ণযুগ চলছে। দ্রব্যমূল্য জনগণের নাগালের বাইরে। ভূমি দস্যুতা ও ব্যাংক লুটে সরকারি দল সব সময়ের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। পুলিশ লেলিয়ে বিরোধী দলের মুখ বন্ধ করা হয়েছে। বিরোধী দলীয় ৫ জন লোক একত্র হলেও নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। সংবিধান মোতাবেক জনগণের সভা সমাবেশ, মুক্ত চিন্তা করার যে অধিকার ছিল, তা শুধু বিজি প্রেসে ছাপা হওয়া সংবিধান নামক বইতে পাওয়া যাবে, বাস্তবে যার কোনো অস্তিত্ব নেই। মৌলিক অধিকারের কথা জনগণ ভুলতে বসেছে। এ অবস্থার পরও সরকারের মানবাধিকার, গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বয়ান দেশে বিদেশে চলছেই তো চলছে। বয়ানের গতি দেখে মনে হয় সরকার যেন একটা চলন্ত ট্রেন, চলছে তো চলছে, থামার কোনো লক্ষণ নেই।
লেখক : কলামিস্ট ও বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা
সম্পাদনা: আশিক রহমান ও মোহাম্মদ আবদুল অদুদ