এস কে সিনহা বিচার বিভাগের মর্যাদা কতটা সমুন্নত রাখলেন?
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় তথা সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি পদে এস কে সিনহার যোগদানের সময় থেকেই বিচারালয়ের ভেতর এবং বাইরে নানাভাবে তিনি আলোচিত-সমালোচিত হচ্ছেন। বিচারালয়ের বাইরে রাজনৈতিক অঙ্গনে এক সময় বিএনপি কেন্দ্রিক রাজনৈতিক জোটের নেতাকর্মী সমর্থকেরা বেশ ক্ষুব্ধ ছিলেন, দেশের সর্বোচ্চ বিচারপতি পদে একজন ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিচারপতি নিয়োগকে তারা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছিলেন, সমালোচনাও করেছিলেন। প্রধান বিচারপতি যখন মিডিয়ার সম্মুখে নানা ইস্যুতে কথা বলছিলেন তখন জনান্তে তার সর্ম্পকে নানা বিরূপ মন্তব্যও তারা করেছেন। কিন্তু সংবিধানের ষোড়শ সংশধনীর রায়ের পর সেই অবস্থান সম্পূর্ণরূপে পাল্টে গেল। তাকে দেশের সবচাইতে সাহসী ও দৃঢ়চেতা বিচারপতি বলেও তাদের দিক থেকে অভিহিত করা হলো। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মর্যাদার নামে পুরো বিষয়টিকে সুদূরপ্রসারী চিন্তা থেকে রাজনীতিকীকরণ করার চেষ্টা হলো। প্রচার-প্রচারণা সেভাবেই শুরু হলো। বিচার বিভাগের জন্য ষোড়শ সংশোধনীর বাতিলকে মাইলফলক বলে বিএনপির অনেকে দাবি করেছেন। অথচ তাদের শাসনকালে বিচারপতিদের কীভাবে পদ থেকে হটানো, নিয়োগদান এবং ব্যবহার করা হয়েছিল তার উদাহরণ তো প্রধান বিচারপতিই অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার সময় দেওয়া তার লিখিত বিবৃতিতেও উল্লেখ করেছেন। তারা কিন্তু সে সম্পর্কে কোনো কথা না বলে বরং এস কে সিনহাকে ‘দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে’ এমন ডুগডুগি ও ঢোল বাজিয়ে যাচ্ছেন, সবার কানের শ্রবণ-শক্তিকে স্তব্ধ করে রাখতে চাচ্ছেন। গত কয়েক মাস থেকে রাজনীতিতে প্রধান বিচারপতি হিসেবে এস কে সিনহাকে নিয়ে যেভাবে মাঠ গরম করা হয়েছে এবং হচ্ছে তা রীতিমতো লজ্জাজনক ও বিপজ্জনক। আদালত পাড়াতেও একটি পক্ষ প্রতিদিন সরকারের বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণার উপাদান হিসেবে প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে মাঠ গরম করছেন, নানা বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। অথচ বিচারালয়ের উন্নতি, অগ্রগতি, মান-সম্মান ইত্যাদির মূল্যায়ন কতখানি হচ্ছে তা কিন্তু দেখা হচ্ছে না। ব্যক্তি এস কে সিনহার মর্যাদাকে প্রধান বিচারপতির মর্যাদার সঙ্গে একীভূত করার প্রচারণা জোরদার করা হয়েছে। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় দেওয়াই যথেষ্ট নয়, রাষ্ট্রের এমন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গনকে ঢেলে সাজানো, এর জন্য দেশের আইন ও বিচারলয়ের যে ধরনের সংস্কারের প্রস্তুতি নেওয়া, কাজ করা, উদ্ভাবনীর ক্ষমতার প্রয়োগ করা, বিদ্যমান নি¤œ আদালত ও উচ্চ আদালতকে ঢেলে সাজানো, স্বাধীন ব্যবস্থার সংস্কৃতিতে গড়ে তোলা- সেই প্রয়োজনীয় কাজগুলোতে মনোনিবেশ না করে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা গোড়া থেকেই কথা-বার্তা, চাল-চলন ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় যে সব বিভ্রান্তি, সন্দেহ এবং সংশয়ের সৃষ্টি করেছেন তা দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযোদ্ধের পক্ষকে বিপদে ফেলে দেয়, দেশের চিহ্নিত সাম্প্রদায়িক এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে রাজনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্তির সুযোগ করে দেয়। আইন ও বিচারলয়ের অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তিই বিষয়টি গভীরভাবে অনুধাবন করতে পেরেছেন বলে মনে হয়নি। তাদের অনেকেই আবেগ তাড়িত হয়েছেন। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও দ্বিচারিতার ফাঁদে পা দিয়ে নিজেরা দুর্বল হয়েছেন।
দেশে একটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায় আছে, তাদের সময়ে বিচার ব্যবস্থা মর্যাদা লাভ করবে। আর তারা সেটির বিরোধিতা করবে তা কী করে হয়, অন্যদিকে প্রতিপক্ষ শক্তি সেটিকে সমর্থন করবে-দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা কি সেরকম কিছু? বিচার বিভাগের এমন একটি উত্তরণ ঘটবে তাতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সমর্থন থাকবে না- ব্যাপারটি কি সেভাবে ভাবা যায়? এখানেই অসংখ্য কিন্তুর জন্ম দেওয়া হয়েছে। রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতির অনেক মন্তব্যই জাতীয় ইতিহাস ও অস্তিত্ব নিয়েও বিভ্রান্তি সৃষ্টির সুযোগ করে দিয়েছে। সেখানেই দূরত্ব সৃষ্টির সকল উপাদান নিহিত ছিল। সেই সব বিতর্কিত মন্তব্যকে হজম করার অর্থ দাঁড়ায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও আদর্শকে বিচারঙ্গনে বিতর্কিতভাবে রেখে দেওয়া। যারা এমনটির বিরোধিতা বারবার করছেন তাদেরকেও রায়ের বিরুদ্ধে শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক মহল এবং মিডিয়াতেও অনেকে বিষয়ের গভীরতাকে স্পর্শ না করে অনেকে অবস্থান নিয়েছেন- যা দুর্ভাগ্যজনক। বস্তুত আমাদের রাষ্ট্রের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের স্বাধীন অবস্থান তৈরির জন্য শুধু সাহসই যথেষ্ট নয়, মেধা, মনন, প্রজ্ঞা, সততা দেশ প্রেমেরও যথেষ্ট সমন্বয় সাধন আবশ্যকীয় শর্ত। পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে তার কতটা উপস্থিতি ও অনুপস্থিত ছিল তা তলিয়ে দেখাও জরুরি। প্রধান বিচারপতি পদে এস কে সিনহা প্রায় সকল ক্ষেত্রেই একক ব্যক্তি হয়ে যেতে থাকলেও বিচারালয়ে অন্যদের সঙ্গে তার দূরত্ব তৈরি হয়ে গেল। তিনি বাহ্যিকভাবে যা বলছিলেন সেগুলো ধারণ ও বাস্তবায়নের প্রজ্ঞা, সততা, মেধা ও দৃঢ়তার অভাব ক্রমেই তার মধ্যে স্পষ্ট হতে থাকে। যা আইনজীবী ও রাজনীতিবিদদের একটি পক্ষ অন্ধভাবে বক্তৃতা ও বিবৃতি দিয়ে আড়াল করে বা ঢেকে রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কিন্তু মোটেও ঢাকা থাকেনি। এরই মধ্যে গণমাধ্যমে এস কে সিনহার বিরুদ্ধে বেশ কিছু আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণসহ প্রচারিত হয়। যার কোনোটিই তিনি প্রতিবাদ করেননি কিংবা এর কোনো প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেননি। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ ছাড়া কোনো গণমাধ্যমই টু শব্দ করবে তা ভাবা যায় না। কয়েকটি গণমাধ্যম তথ্যপ্রমাণাদি প্রকাশ করে দিল। কিন্তু তিনি কোনো প্রতিবাদ করেননি। ফলে বিষয়টি রাষ্ট্রের অভিভাবক রাষ্ট্রপতির স্বীয় ক্ষমতা ও বিবেচনায় নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ক্ষমতার প্রয়োগ না ঘটিয়ে সর্বোচ্চ বিচারলায়ের কথা বিবেচনা করে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিদের মতামত নিলেন। বিচারপতিগণ প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে আনিত সুস্পষ্ট ১১টি অভিযোগের বিষয় তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মতামত জানতে চান। প্রধান বিচারপতি সেই থেকে ভারসাম্যহীন আচরণ এবং একের পর এক নাটকীয় ঘটনার জন্ম দিতে থাকেন। তিনি যাই করছিলেন তাই সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল বিএনপি-জামায়াত ঘরনার আইনজীবী এবং দলসমূহ। তার অসুস্থতার নাম করে ছুটির আবেদন, বিদেশ যাওয়ার আবেদন, মন্দিরে যাওয়া, বিদেশি দূতাবাসে ভিসার জন্য যাওয়া সবই তার ব্যক্তিগত বিষয় থাকা সত্ত্বেও বিরোধী দল প্রধান বিচারপতি গৃহবন্দী, সরকারের চাপে তিনি অসুস্থ, বিদেশ যেতে বাধ্য হচ্ছেন-ইত্যাদি বলে দেশবাসীকে যে বার্তা দিচ্ছিল-তা মোটেও ভেতরের কাহিনীর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। অবশেষে প্রধান বিচারপতি অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে ঘর থেকে যাত্রা করেই মিডিয়ায় যে সব কথা বললেন তাতে বিভ্রান্তি বেড়ে গেল। তিনি যদি গৃহবন্দী হন তাহলে তিনি এতকিছু করছিলেন কীভাবে, বিদেশে গেলেন কীভাবে, তিনি শুধু মুখেই কথা বলেননি, লিখিত বিবৃতিও সাংবাদিকদের মধ্যে তিনি বিতরণ করেন। তার সব কথা ও বক্তব্যই বিভ্রান্তিকর, এলোমেলো, অসংলগ্ন, সর্বোপরি প্রধান বিচারপতির পদের মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। তিনি একদিকে বিচারলয়কে কলুষমুক্ত করার আহ্বান জানালেন, অন্যদিকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব সর্ম্পকেও সংবিধান বিরোধী বক্তব্য দিলেন। একটি গভীর সংকটে দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়কে রেখে তিনি যখন বিদেশে যান, তখন সুপ্রিম কোর্ট বাধ্য হয়েই এর ব্যাখ্যা প্রদান সহ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এস কে সিনহার ছুটিতে যাওয়ার পরিস্থিতির একটি বিবরণ তুলে ধরেন। এই বিবৃতির পর কোনো মহলেরই দেশের সর্বোচ্চ আদালতের ভেতরে প্রধান বিচারপতিকে কেন্দ্র করে এই সময়ে ঘটে যাওযা বেশ কিছু ঘটনা নিয়ে আর কোনো বিভ্রান্তি ও সন্দেহ থাকার সুযোগ নেই। আদালতের মর্যাদার প্রতি যদি তারা শ্রদ্ধাশীল হন তবে তাদের তাই করা উচিত। কিন্তু এখন সেই মহলটি আদালতের বক্তব্যকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। পুরাতন ঢোলই বাজাচ্ছেন। এস কে সিনহার সাহসকে সম্মুখে নিয়ে আসছেন। একেই বলে পৃথিবীর জঘন্যতম অপরাজনীতি। সেই অপরাজনীতি করতে যাদের বুদ্ধি, বিবেক ও বিচার ক্ষমতা কাজ করে না, তাদের হাতে রাষ্ট্রের বিচারালয়, রাষ্ট্র ব্যবস্থা, সভ্যতা সবই ধ্বংস হতে বাধ্য। কারণ বিবেক ও বুদ্ধি বিবর্জিত মানুষ ও দলের অবস্থানটিও পরিষ্কার হচ্ছে।
লেখক : অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান