বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ পাচ্ছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা
হাসান আরিফ: বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক মানে পৌঁছে গেছে। তাই এইসব প্রতিষ্ঠানকে বিদেশে বিনিয়োগ করার সুযোগ দিতে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে সরকার। অর্থনৈতিক সংক্রান্ত মন্ত্রী সভা কমিটি এই অনুমোদন দেয়।
এদিকে বিদেশে বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ থেকে দেশে লাভ হবে বলে মনে করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নীতিনির্ধারকরা। তাই নীতিমালা তৈরি করতে ৬ সদস্যের কমিটি কাজ শুরু করেছে। অপরদিকে বাজার থেকে বিদেশি কোম্পানির টাকা তোলার বিধিও শিথিল করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে বিভিন্ন দেশ থেকে এফডিআই আকর্ষণের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। আর বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাছাড়া ব্যয় হ্রাস, কান্ট্রি অফ অরিজিনের সুবিধা গ্রহণ, বিভিন্ন বিশেষ কাঁচামাল সোর্সিং এর সুবিধা গ্রহণ, পণ্যের গ্রাহকের সঙ্গে ভৌগোলিক নৈকট্য নিশ্চিত করার প্রয়োজন রয়েছে। তাই বাংলাদেশের কোম্পানিগুলোকে বিদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করার প্রয়োজন আছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের বিদেশে বিনিয়োগ করার সুস্পষ্ট নীতিমালা নাই। ফলে বিদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অসুবিধার সৃষ্টি হচ্ছে। তাই এ বিষয়ে একটি নীতিমালা তৈরির উপর গুরুত্ব দিয়ে নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে একটি কমিটি নীতিমালা তৈরির কাজ করছে। সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এ সংক্রান্ত একটি সভাও হয়েছে। সভায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এসময় তারা বলেছেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পর্যায় ও কৌশল, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিয়োগ নীতিমালা, দেশের অভ্যন্তরে বিনিয়োগ বা অর্থায়নের প্রয়োজনীয়তার পর্যালোচনা প্রয়োজন। তাই যথাযথ বিশ্লেষণ করে নীতিমালা তৈরির বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। ওই সভা থেকেই নীতিমালা তৈরির জন্য ৬ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়। কমিটির সমম্বয়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী সদস্য-১ অজিত কুমার পালকে। সদস্য হিসেবে অর্থ বিভাগ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন করে প্রতিনিধি রয়েছেন।
আর সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন বিনিয়োগ বোর্ডের উপ-পরিচালক।
এদিকে বিদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাজার থেকে টাকা তোলার সুযোগ দিতে একের পর এক বিধি শিথিল করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন থেকে টাকা বন্ড ছেড়ে স্থানীয় বাজার থেকে টাকা তোলার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানকে। চলতি মাসে তাদের এই সুযোগ করে দেওয়ার সার্কুলার জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আগে বিদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো চলতি মূলধনের জন্য স্থানীয় ব্যাংক থেকে স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর বৈদেশিক মুদ্রা না এনেও টাকায় বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদেশি কোম্পানিগুলোর বাজার থেকে টাকা তোলার অবাধ সুযোগ করে দেওয়ায় কার্যত ঝুঁকির মুখে ফেলা হয়েছে দেশি বিনিয়োগকারীদের। কারণ বিদেশি কোম্পানিগুলো জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা পাচার করে দেউলিয়া ঘোষণা করলে বা অতিরিক্ত মুনাফা দেখিয়ে তা বিদেশে স্থানান্তর করলে পথে বসে যাবেন স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা। এ বিষয়টিকে অবশ্যই আমলে নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জারিকৃত সার্কুলারে বলা হযেছে, বিদেশি ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ড ইস্যু করে স্থানীয় বাজার থেকে টাকা তুলতে পারবে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) অনুমতিসাপেক্ষে তারা এ বন্ড ইস্যু করতে পারবে। দেশের যে কোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এ বন্ডে বিনিয়োগ করতে পারবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত একটি পরিপত্র জারি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ অনুমোদন ছাড়া বিদেশি মালিকানাধীন কোনো প্রতিষ্ঠান টাকায় বন্ড ছেড়ে বাজার থেকে টাকা তুলতে পারত না। আবার দেশে কোনো বিনিয়োগ করতে চাইলে বৈদেশিক মুদ্রায় বিনিয়োগ করতে হতো। এ ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রায় তহবিল এনেই কেবল স্থানীয় কোনো কোম্পানির শেয়ার কিনতে পারত। কিন্তু এখন তা টাকায় বিনিয়োগের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, স্থানীয় মুদ্রায় ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর বিদেশি কোম্পানির নির্ভরশীলতা কমাতে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর আগে চলতি বছরের ২৩ মার্চ বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে টাকায় চলতি মূলধন সংগ্রহে (তহবিল) কমার্শিয়াল পেপার ইস্যুর ক্ষমতা দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, বিদ্যমান বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন ব্যবস্থায় বিদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান স্থানীয় পর্যায়ে অর্থায়নের ক্ষেত্রে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। কারণ ব্যাংক ভিন্ন অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান এসব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ প্রদানের জন্য প্রাধিকারপ্রাপ্ত নয়। বিদ্যমান বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৪৭ এর ১৮(২) ধারায় বিদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে স্থানীয় মুদ্রায় (টাকায়) চলতি মূলধন ঋণ সুবিধা প্রদানের সাধারণ প্রাধিকার দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলোর অনুকূলে দেওয়া আছে। তবে বর্তমানে তারা দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে স্বল্প সময়ের জন্য চলতি মূলধন ঋণের পাশাপাশি শর্তসাপেক্ষে মেয়াদি ঋণও নিতে পারে। ২০১৪ সালের মার্চে বাংলাদেশ ব্যাংক এক পরিপত্রে দেশের উৎপাদন ও সেবা খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে মেয়াদি ঋণ নেওয়ার সুযোগ করে দেয়। ওই পরিপত্র অনুযায়ী, যেসব বিদেশি প্রতিষ্ঠান তিন বছরের অধিক সময় ধরে বাংলাদেশে কার্যক্রম চালাচ্ছে তারাই এ ঋণ নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি জানান, যেভাবে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে তাতে তাদের বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়ার আশঙ্কা করছেন। কারণ স্থানীয় বাজার থেকে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো যে ঋণ নিচ্ছে তার সুনির্দিষ্ট কোনো গ্যারান্টার নেই। কখনো কোনো প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া ঘোষণা করলে তাদের পুরো বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়ে যাবে। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরো বিচার-বিশ্লেষণের প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।