মুখের কথার শক্তি ও বেশি বলার শাস্তি
মো. আবদুল কুদ্দুস
কথায় আছে, মানুষের জন্মের পর কথা বলা শিখতে সময় লাগে মাত্র দুই বছর। অথচ একজন মানুষ হয়ে, কী কথা বলা যাবে না, তা শিখতে সময় লাগে সারা জীবন। কেননা, সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে ‘বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা’ (মানে কোনো রাষ্ট্র প্রধান বা দল পূর্বে গণতন্ত্রকে হত্যা করেছিল) উল্লেখ করে সমালোচনার ঝড় তুলেছেন। অন্যদিকে প্রধান বিচারপতি জাতীয় সংসদকে অপরিপক্ক ও বাংলাদেশকে পৃথিবীর সব থেকে ব্যর্থ রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করে বাঙালি জাতিকে লজ্জায় ফেলেছেন। কথা বলার শক্তি ও বেশি কথা বলার শাস্তি বিষয়ক একটি ইতিহাস আশ্রিত গল্পের অবতারণা এখানে প্রণিধানযোগ্য। গল্পটি দিল্লির বাদশাহ জাহাঙ্গীর ও দিল্লির শাসনের প্রতি অনুগত নদীয়ার কৃষ্ঞনগর অঞ্চলের অধিপতি ভবানন্দ মজুমদারের রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে নেওয়া। ইতিহাসটি এরকম-
‘যশোরের অধিপতি রাজা প্রতাপাদিত্য দিল্লির শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। বাদশা জাহাঙ্গীর তখন দিল্লির মসনদে। বাদশা জাহাঙ্গীর বিদ্রোহী রাজা প্রতাপাদিত্যকে দমন করার জন্য বিশাল এক সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। সেনাপতি রাজা মানসিংহ। দিল্লির মানুষের জন্য বাংলার আবহাওয়া, জলবায়ু অতিমাত্রায় প্রতিকূল। বাংলায় তাদের জন্য নিরাপদ একটি আশ্রয় প্রয়োজন। আশ্রয় দিয়েছিলেন দিল্লির শাসনের প্রতি অনুগত নদীয়ার কৃষ্ণনগর অঞ্চলের অধিপতি রাজা ভবানন্দ মজুমদার। কিন্তু অন্নদা দেবীর এক কূটকৌশলে ঝড়, বৃষ্টি, বন্যায় মানসিংহ মহাবিপদে সম্মুখীন হলেন, তবে ভবানন্দ মজুমদারের আরাধ্য দেবী অন্নদার কৃপায় মানসিংহ বিপদ থেকে পরিত্রাণ লাভ করেন। সেকালের শিষ্টাচার অনুযায়ী রাজা মানসিংহ দূতের মাধ্যমে রাজা প্রতাপাদিত্যের কাছে বেড়ী এবং তরবারী পাঠিয়ে দেন। রাজা প্রতাপাদিত্য দূতের কাছ থেকে তরবারী হাতে তুলে নেন।
এর অর্থ দিল্লির শক্তির বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। দিল্লির বিশাল শক্তির কাছে যুদ্ধে রাজা প্রতাপাদিত্য পরাজিত হন। রাজা মানসিংহ তাকে খাঁচায় বন্দী করে দিল্লিতে বাদশাহ জাহাঙ্গীরের কাছে নিয়ে যায়। অপরদিকে কৃতজ্ঞতার নিদর্শন হিসেবে ভবানন্দ মজুমদারকে সঙ্গে নেন বাদশা জাহাঙ্গীরের মাধ্যমে সম্মানিত করার জন্য। দিল্লীর পথে অনাহারে অর্ধাহারে রাজা প্রতা-পাদিত্যের করুণ মৃত্যু ঘটে। তার মৃতদেহ ঘিতে ভেজে দিল্লি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। বাংলার বিদ্রোহ দমনে রাজা মানসিংহের সাফল্যে বাদশাহ জাহাঙ্গীর মহাখুশি। তবে ভবানন্দ মজুমদার এবং তার সঙ্গী-সাথীদের বন্দীশালায় রাখতে নির্দেশ দেন।
কারাগারে বন্দীদের ওপর চালানো হয় নিষ্ঠুর নির্যাতন। ভবানন্দ মজুমদারের বিশ্বস্ত একজন চাকরের নাম ছিল বাসু। নির্যাতিত বাসুর মুখে উচ্চারিত হয়-দুধে ভাতে ছিল ভাল, হেন বুদ্ধি কেটা দিল পাতশার দেয়ানে আসিতে। ‘বাসু’ ভবানন্দের চাকর হলেও তার মুখ দিয়ে একটি চিরন্তন সত্যের প্রকাশ ঘটেছে। পরিশেষে বলতে চাই, বাংলার মাটিতে বিশ্বাস ঘাতকদের কোনো ঠাঁই নেই। ক্ষণিক লাভের আশায় কোনো রাষ্ট্রীয় পদস্থ ব্যক্তি যদি নিরহ বাঙালির সঙ্গে বিশ্বাস ঘাতকতা করেন তবে তাদের শাস্তি অনিবার্য।
লেখক : শিক্ষক, নর্থ বেঙ্গল ইন্টা. ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী
সম্পাদনা : আশিক রহমান ও মোহাম্মদ আবদুল অদুদ