অং সান সুচি কি সত্যিই অসহায়!
ড. মো. আনিসুর রহমান ফরাজী
‘রোহিঙ্গা সমস্যা : চরম সংকটে বাংলাদেশ’ আজ পর্যন্ত কোনো পথ খোলা হচ্ছে না রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের! চরম আতঙ্ক এবং প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে লিখার সূত্রপাত করতে চাই। মিয়ানমারের গণতন্ত্র পিয়াসী নেত্রী অং সান সুচি, বিশ্বের শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সুচি বিশ্ব পরিচিত একটি নাম। মিয়ানমারের একমাত্র নেত্রী বিশ্ব দরবারে যার নাম বিস্তৃত। একটি টক শো’তে ক্ষমতাসীন সরকারের শুভাকাঙ্খী একজন প্রথিতযশা সাংবাদিক বলেছেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে অং সান সুচি অসহায়! বিষয়টি একটি বিশ্লেষণের দাবী রাখে। উদাহরণ স্বরূপ কেউ যদি সাগর মহাসাগর বা গানের কথায় সাত সাগর আর তেরো নদী পার হয়ে এসে একটি নালা বা খাল এর সামনে দাঁড়িয়ে বলে আমি এখন অসহায়! তা কি মেনে নেওয়া যায়?
মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য, যার রয়েছে অতীত ইতিহাস, ১৮২৪ সাল থেকে যে রাজ্য ছিল প্রতাপ সেই রাজ্যের অধিবাসী রোহিঙ্গারা, আজ বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। প্রায় দুইশতাধিক বছর পর আজ মিয়ানমার সেনাপ্রধান বলছেন, এরা বৃটিশদের রেখে যাওয়া বাংলাদেশ অঞ্চলের মানুষ; এরা বাঙালি। সুতরাং বাংলাদেশই হবে এদের বাসস্থান। তাহলে দুইশত বছরের ইতিহাসের বাঙালি আরাকান রাজ্য কত জনসংখ্যা তৈরি করেছে এর কি হিসেব পাওয়া যাবে? জাতি গঠনে সব বাঙালি বাংলাদেশি তা নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি অর্থাৎ বাংলা-ভাষাভাষীর মানুষ রয়েছেন, তারাও বাঙালি কিন্তু বাংলাদেশি নন।
অনুরূপ বিশ্বের প্রতিটি দেশেই কিছু না কিছু বাঙালি গিয়েছেন, সেখানেও প্রজন্মের পর প্রজন্ম তৈরি হয়েছে এবং অনেকেই অন্য দেশে জন্মলাভ করে সে সমস্ত দেশের নাগরিকত্ব জন্মসূত্রেই পেয়েছেন। তবে দুইশত বছরের জাতি গোষ্ঠী কেন নাগরিকত্ব পাবে না? মানুষ ইতিহাস গড়ে। মানুষই ইতিহাস সৃষ্টি করে। সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানব বৈষম্যতা সৃষ্টি হয়েছে। তারপরেও পৃথিবী এগিয়েছে, ভবিষ্যতে আরও এগুবে; অনেক প্রাণিকুল ধ্বংস হয়েছে। পৃথিবীর মহাশক্তিধর, মানব সম্পদ ধ্বংসকারী ভয়ংকর প্রাণী ডাইনোসোরাস প্রজাতী ধ্বংস হয়েছে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মানবকূলে বার বার ধ্বংস হয়েছে, বা হচ্ছে তার পরও কিন্তু মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়েছে বা দাঁড়াচ্ছে। রোহিঙ্গারাও মানুষ! জাতিগতভাবে এদেরও মানবাধিকার রয়েছে। এর সেই মানবাধিকার থেকেই রোহিঙ্গা সম্প্রদায় আরাকান রাজ্য থেকে শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে স্থান নিয়েছে। বাংলাদেশ মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকেই লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা সবই দেয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে অন্যান্য সুবিধাসহ অস্থায়ী বাসস্থানও নির্মাণ করা হচ্ছে। তবে এই অস্থায়ী বাসস্থান যা হবে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত তা কি একদিন স্থায়ী বাসস্থানে পরিণত হবে? প্রশ্নটি রইল; সদাশয় সরকার, শ্রেণি, গোষ্ঠী সকলের কাছে। আরাকান রাজ্যের রোহিঙ্গাদের উপর দীর্ঘদিনের বৈষ্যমতায় সুবিধা বঞ্চিত সম্প্রদায় হিসেবেই রোহিঙ্গারা বসবাস করে আসছিল। ক্ষণে ক্ষণে তাদের উপর অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার, পাশবিকতা ইত্যাদি চালিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পুশইন করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ কোনো দিন রোহিঙ্গাদের পুশব্যাক করতে পারেনি। যেমনটি ভারতীয় সীমান্তের মাঝে মধ্যে হতো। তবে সেই ব্যাপারটি তেমন স্পর্শকাতর হয়ে উঠেনি।
রোহিঙ্গা পুশইন ক্ষেত্রে স্পর্শকাতর বিষয় দাঁড়িয়েছে, সংখ্যা গরিষ্ঠ শ্রেণি গোষ্ঠীর উপর অমানবিক নির্যাতন। প্রকাশ্যে, দিন দুপুরে রোহিঙ্গাদের উপর পাশবিক নির্যাতন, কুপিয়ে হত্যা, গণহত্যা, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ নাশ একি বর্বরতা! আজ আর আদিকাল নয়। এটি বিশ্বায়নের যুগ। এটিকে বলা হয় গ্লোবাল ভিলেজ। তা হলে কি ভাবে একটি গ্লোবাল ভিলেজে এতো বর্বরতা ও নৃশংসতা চলে?
আদি যুগে মিডিয়া ছিল না। কারও খবর প্রচারের কোনো সুযোগ ছিল না, মানুষ নিজ চোখে দেখে তাহা বিশ্বব্যাপী ছড়াতে পারত না; কিন্তু এখন বিশ্ব-মিডিয়ার যুগ ডিজিটাল যুগ; রয়টার, বিবিসি, সিএনএন, আল জাজিরার যুগে মুহূর্তে মুহূর্তে বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের খবর বিশ্ববাসী দেখতে পারছেন, সচিত্র প্রতিবেদন হচ্ছে, বিশ্লেষণধর্মী অনুষ্ঠান ‘হার্ড টক’ টক শো হচ্ছে। অনেক বড় বড় সমস্যার সমাধান হচ্ছে, তবে রোহিঙ্গাদের সমস্যার সমাধান হচ্ছে না কেন? সদা জাগ্রত বিশ্ব চব্বিশটি ঘণ্টা দেখছে রোহিঙ্গাদের উপর অমানবিক আক্রমন তথা মানুষের উপর মানুষের আক্রমন। বিশ্ব শান্তির দূতেরা আসছেন। রোহিঙ্গাদের খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য শুধু ত্রাণ সামগ্রী দিচ্ছেন, চিকিৎসা সাহায্য দিচ্ছেন, অস্থায়ী ক্যাম্পে স্যানিটেশন তৈরি হচ্ছে, কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে কোনো স্থায়ী সমাধান আসছে না।
কফি আনান কমিশন, জাতিসংঘ তামাম দুনিয়ার বিশ্বনেতৃবৃন্দ আজ একটি ক্ষুদ্র সমস্যার সমাধান দিতে পারছেন না; না তারা কেউ সমাধানটি চাচ্ছেন না? এটি কি উদ্দেশ্য প্রনোদিতভাবে বাংলাদেশের উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন?
না তা হতে পারে না। বাংলাদেশ এ বোঝা বহন করতে পারে না। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। ভৌগলিক সীমানায় বাংলাদেশের আয়তন ছোট, কিন্তু জনসংখ্যা অত্যন্ত বেশি এবং ঝুঁকি বহুল। তার মাঝে অন্য একটি দেশের একটি অংশের বাসিন্দাদেরকে বাংলাদেশে ঠেসেঠুসে স্থান দেওয়া যায় না। একটি জেনারেশন আর একটি জেনারেশনকে একদিন ধাক্কা দিবে। তখন আরও বিস্ফোরন ঘটবে। তখন কে কোথায় যাবে?
গণতন্ত্রের মানসকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা, বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব দরবারে রোহিঙ্গা সংকট উপস্থাপন করেছেন। পাঁচ দফা দাবী উত্থাপন করেছেন। রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের স্থায়ী সমাধান চেয়েছেন। লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাদের আশ্রয়, খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা দিয়েছেন; কিন্তু এদের কর্মের সংস্থান, এদের শিক্ষা ব্যবস্থা কি হবে?
কোথায় হবে? কোন জাতিসত্ত্বা নিয়ে এরা বেঁচে থাকবে? এ নিয়ে আছে হাজারো প্রশ্ন। কিন্তু তার সমাধান কে দিবে? একমাত্র মিয়ানমারই পারে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান দিতে। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী গণতন্ত্রকামী অং সান সুচিই পারেন এই সমস্যার সমাধান দিতে। তিনি অসহায় নন। তিনি তার অসহায়ত্বের ভান করছেন। তিনি সাত সাগর তেরো নদী পার হয়ে মরা খালের কিনারে দাঁড়িয়ে বলছেন আমি অসহায়। তার অসহায়ত্বকে আমরা সায় দিতে পারি না। এ অসহায়ত্বের সায় কেউ দিতে পারে না। যে নেত্রী দুই যুগেরও বেশি অন্তরীন থেকে, কারা বাস করে, জুলুম অত্যাচার সহ্য করে সামরিক জান্তা নিয়ে সরকার গঠন করেছেন, তার ক্ষমতার সময়ে কেন তিনি অসহায়ত্ব বোধ করবেন?
তিনি যদি আজ সত্যিকার অর্থে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী হন, গণতন্ত্রকামী চরম ধৈর্যশীল নেত্রী হন তাহলে একমাত্র তিনিই এবং গণতন্ত্রের মানষকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ ভাবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন অর্থাৎ আরাকান রাজ্যের স্থায়ী নিবাসে ফিরিয়ে নিতে পারেন। বিশ্বশান্তির জন্য শেখ হাসিনাও একদিন নোবেল বিজয়ী হতে পারেন। এতে দেশ বাঁচবে, জাতি বাঁচবে জেগে উঠবে মানুষের প্রাণ। হিংসা-বিদ্বেষ জাতি বৈষম্য থাকবে না। বিশ্ববাসী শুধু শান্তির মিছিল দেখবে। নেত্রী অং সান সুচি হয়ে উঠবেন এক মহা মানবী। তিনি যদি নিজের মনকে শুধরায়ে একবার এগিয়ে আসেন; আমি অং সান সুচি এগিয়ে আসছি বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে; বিশ্ববাসী আমার পাশে আসুন তাহলে কোটি কোটি জনতার মিছিলের অগ্রপথিক হবেন অং সান সুচি আর বিশ্ববাসী অভিনন্দন জানাবেন সুচি তুমি এগিয়ে চলো; বিশ্ব আছে তোমার সাথে। সামরিক জান্তা নিপাত যাক; গণতন্ত্র মুক্তি পাক। তাহলে কোনো দিন আর গর্জাবে না মিয়ানমারের সামরিক জান্তাদের কামান, বেরুবেনা আর একটি গুলি, বন্ধ হবে জ্বালানো পোড়ানো, পাশবিক অত্যাচার, নির্বিচারে মানুষ খুন। লক্ষ জনতার মুখে ফুটে উঠবে দুই দেশের দুই নেত্রীর নাম এই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : অধ্যক্ষ, ইন্টারন্যাশনাল নার্সিং কলেজ, টঙ্গি, গাজীপুর