‘আরবিটরাজ’ সম্পর্কে অজ্ঞতা থাকলে ডিম ভেঙে যাবে; দুর্গন্ধ বেরুবে
‘আরবিটরাজ’ হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বা ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণি-গোষ্ঠীর জন্য একই দ্রব্য (ঈড়সসড়ফরঃু) বা সম্পদ (অংংবঃ) এর মূল্যের পার্থক্য থাকলে এই পার্থক্যকে পুঁজি করে কিছু লোক এক বাজারে কম দামে দ্রব্য-সম্পদ ক্রয় করে অন্য বাজারে বেশি দামে বিক্রি করবে। এর মাধ্যমে সে উল্লেখযোগ্য লাভ হাতিয়ে নেবার সুযোগ পাবে। এটি অর্থনীতির একটি অতি সাধারণ সূত্র। আপ্তবাক্য। শুনলে মনে হয়, বিষয়টি বোধ হয় সবাই জানে, সবাই বোঝে। বাস্তবতা কিন্তু তা বলে না। ‘আরবিটরাজ’ সম্পর্কে ধারণা না থাকায় বাস্তব ক্ষেত্রে অনেক সমস্যার উদ্ভব হতে দেখেছি; এখনো দেখেছি। এ অজ্ঞতার কারণে নানারূপ বিভ্রান্তি এবং সমস্যার সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শুরু করে সমবায়, সরকারি এবং বেসরকারি ব্যাংকের পরিষদ দায়িত্ব পালন করেছি। এসব পরিষদে পেশাগত বিশেষজ্ঞের সঙ্গে বিভিন্ন গোষ্ঠী আদর্শের লোক অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এরা বেশিরভাগই জনদরদী, কৃষক দরিদ্র কিংবা এনজিও দরদী। এরা বেশিরভাগ গ্রাহককে বিনা সুদে অথবা স্বল্পসুদে ঋণ দেওয়ার পক্ষগতি ছিলেন। এদেরকে বোঝানো যেত না যে, স্বল্প সুদে ঋণ দিলে ঋণ গ্রহিতারা সে ঋণ গ্রহণ করে বেশি সুদে তা অন্যত্র বিক্রি করে দিবে, এককথায় তারা বুদ্ধি খরচ করে ঋণের ব্যবসা করবে। যে উদ্দেশ্যে বা যে কাজের জন্য ঋণ দেওয়া হয়েছে সে কাজ তারা করবে না। স্বল্প সুদে ঋণ দানের উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।
এরূপ ‘আরবিটরাজ’-এর মাধ্যমে বাংলাদেশে বহু ঋণের অপব্যবহার ঘটছে। সরকার তথা জনমানুষের টাকার শ্রাদ্ধ হয়েছে। অল্প সুদে ঋণ নিয়ে সে ঋণ হয় বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে, অথবা ঋণগ্রহিতার পছন্দ মতো অন্য কোনো কাজে খরচ করা হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে। পরে তো কু-ঋণে (ইধফ ফবনঃ) পর্যবসিত হয়েছে।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ‘তিন টাকার ডিম’ কেলেঙ্কারি ‘আরবিটরাজ’-এর ধারণাটি দেশের শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকল মানুষের কাছে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে। তাদের চোখ খুলে দিয়েছে। এদিক থেকে ডিম বিক্রির উদ্যোক্তরা দেশের স্বার্থে একটা বড় কাজ করেছেন। ভবিষ্যতে লোক রঞ্জনের জন্য এরূপ উদ্ভট সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তিনবার চিন্তা করবেন। অর্থনীতির স্বতঃসিদ্ধ নীতি-আদর্শের পরিপন্থী সিদ্ধান্ত নিয়ে যে বেশিদূর এগোনো যায় না। সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে উদ্যোক্তরা এবং ব্যবসায়ী সমাজ কিছুটা হলেও তা বুঝতে পেরেছেন। আশা করা যায় তারা ভবিষ্যতে চিন্তা ধান্তা করে, বোঝে সুঝে কাজ করবেন।
বাজারে ডিমের দর (চৎরপব) প্রতিটি সাত থেকে আট টাকা। ডজন ৮৪ থেকে ৯৫ টাকা। সেখানে যদি কোনো স্থানে প্রতিটি ডিম তিন টাকা অর্থাৎ ডজন ৩৬ টাকায় বিক্রি করা হয় তবে কম দামে ডিম কেনার জন্য লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়বে এটাতো স্বাভাবিক। কেউ বেশি করে ডিম কিনে মজুদ করবে, কেউ তা অন্য বাজারে বিক্রি করে প্রচুর লাভ করবে। যদি প্রচার বা উৎসাহ প্রদানের জন্য দাম নির্ধারণ করতে হতো তবে প্রতিটি ডিম পাঁচ থেকে ছয় টাকা, ডজন ৬০-৭২ টাকায় নির্ধারণ করা যেত। তাহলে ক্রেতা সাধারণ উৎসাহিত হলেও অতি লাভের আশায় লোকজন জড়ো হতো না। কারণ ডজনে ১৫-২০ টাকা লাভের জন্য যে ‘ট্রানজেকশন কস্ট’ দিতে হতো, তারা এতে আগ্রহী হতো না। মূল্য নির্ধারণ কালে সতর্কতা অবলম্বন না করলে মানুষের চাপে ডিম ভেঙে যাবে। দুর্গন্ধ বেরুবে।
লেখক : সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব