অহংকার নির্মূলের ওষুধ
অহংকার মনের কুস্বভাবের অন্যতম একটি। অন্যের সঙ্গে তুলনা করে নিজের বড়ত্ব ও গুণ নিয়ে গর্ববোধ করাই হলো অহংকার। রাসুল (সা.) সাহাবিদেরকে অহংকার করতে নিষেধ করেছেন। এ থেকে রক্ষার দোয়া শিখিয়েছেনÑ‘হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে অহংকারের বায়ু থেকে আত্মরক্ষার আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’ নিজের জন্য যা ভালো মনে করা হয়, অন্যের জন্য সেটা ভালো মনে না করা, অন্যের উপদেশ গ্রহণ না করা ও অন্যকে উপদেশ প্রদানে কঠোরতা করা অহংকার প্রদর্শনের আলামত। মানবসৃষ্টির প্রাক্কালে আল্লাহতায়ালা সমস্ত ফেরেশতাকে বললেনÑ‘তোমরা আদমকে সেজদা করো। সবাই করলো, কিন্তু ইবলিস করলো না। সে অস্বীকার ও অহংকার করলো।’ (সুরা বাকারা : ৩৪)। আল্লাহতায়ালা জিজ্ঞেস করলেনÑ‘কোন জিনিস তোমায় আমার নির্দেশ পালনে অবাধ্য করলো? মূলত সে অহংকার করেই আদমকে সিজদা করলো না।’ (সুরা আরাফ : ১২)। ঠিক তেমনি ফেরাউন, নমরুদ অহংকারের বশবর্তী হয়েই নিজেদের খোদা দাবি করেছিলো। অথচ মসিহ ও আল্লাহর ফেরেশতারা নিজেদের আল্লাহর বান্দা স্বীকার করতে লজ্জাবোধ করেন না। (সুরা নিসা : ১৭২)। এমনকি জাহেলি যুগে কাফেররা রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে দম্ভ করে সমূলে ধ্বংস হয়ে গেছে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘মক্কা-তায়েফের শ্রেষ্ঠ দুই ব্যক্তির ওপর কেনো কোরআন নাজিল হলো না? কেনো একজন এতিমের ওপর নবুওয়ত ও কোরআন এলো? তারা অহংকারবশত এতিমকে এতো বড় দায়িত্বে মেনে নিতে পারেনি।’ (সুরা জুখরুফ : ৩১)। অহংকার সম্বন্ধে যুগে যুগে আম্বিয়ায়ে কেরাম (আ.) নিজ নিজ উম্মতকে সতর্ক করেছেন। হাদিসে কুদসিতে আছেÑআল্লাহতায়ালা বলেনÑ‘অহংকার আমার ভূষণ। যে অহংকার করে, সে কেমন যেনো আমার চাদর নিয়ে টানাটানি করে। আর এটা করলে আমি তাকে জাহান্নামে পাঠাবো।’ আরেক হাদিসে বর্ণিত আছেÑ‘যার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে যেতে পারবে না।
অহংকার প্রধানত চার প্রকার। ওজ, কিবর, তাকাব্বুর ও ইস্তিকবার। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়Ñ১. বীজ : আমি কথা বলতে পারি, ইত্যাদি গুণের কারণে আমি প্রশংসিত; তাহলে বুঝতে হবে অন্তরে অহংকারের বীজ পয়দা হয়েছে। ২. চারা : যে ঐ প্রশংসার দাবি মুখ দিয়ে প্রকাশ করে; বুঝতে হবে তার মাঝে অহংকারের চারা জন্মেছে। ৩. গাছ : যে অন্যের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করে বড় মনে করে; বুঝতে হবে তার মাঝে অহংকারের গাছ পয়দা হয়েছে। ৪. ফসল : নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে অন্যের সঙ্গে যে অবিচার করা হয়, তাকে অহংকারের ফসল বলে। আমাদের কি কি গুণ আছে, নিজেই নিজের কাছে জিজ্ঞেস করি। উত্তর আসবে, আমি কথা বলতে পারি, এটা আমার গুণ; কানে শুনি, এটা আমার গুণ, ইত্যাদি। যদি মনে করি, আমার গুণের কারণে আমি প্রশংসিত, তাহলে বুঝতে হবে অহংকার আমায় ঘিরে ধরেছে। আর যদি মনে করি, প্রশংসিত নই, বরং আমার গুণগুলো যিনি দান করেছেন, প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য কেবল তিনি; তাহলে তা হবে শুকরিয়া বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। চেষ্টা করে হলেও মন্দ গুণগুলি আগাছার মতো পরিস্কার করা চাই। সর্বোপরি সাধনা করে ভালো ও শুকরিয়ার গুণ অর্জন করা জরুরি।
মুজাহিদে আজম আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরি (রহ.) স্বীয় শায়খ হজরত থানবি (রহ.)-এর বরাবর একবার চিঠি লিখলেনÑ‘লোকেরা আমায় ওয়াজ করতে বলে। আপনার অনুমতি চাই।’ হজরত বললেনÑ‘আজ থেকে ৬ মাস পর্যন্ত প্রয়োজনের অতিরিক্ত কারো সঙ্গে তোমার কথা বলাই নিষেধ।’ এভাবে আরেকবার হজরত থানবি (রহ.)-এর দরবারে মুরিদ হয়ে এক নবাব বাড়িতে চিঠি লিখলেনÑ‘নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে কম টাকা পাঠালে আমার নবাবত্ব প্রকাশ পায় না।’ হজরত থানবি (রহ.) চিঠি পড়ে ডাকে ছাড়ার অনুমতি দিয়ে বললেনÑ‘আজ থেকে তোমার এই মসজিদের সমস্ত মুসল্লির জুতো সোজা করলেই হবে না, বরং পায়ে পরিয়ে দিতে হবে।’ হজরতের দরবারে একবার এক আলেম এসে বললেনÑ‘আমায় খেলাফত দেন না কেনো?’ হজরত থানবি (রহ.) বললেনÑ‘সহ্য করতে পারবে না।’ মুরিদ বললেনÑ‘জী, পারবো।’ হজরত বললেনÑ‘আমার পকেট থেকে টাকা নিয়ে অঙ্গুর কিনে বাজারের মাস্তান ছেলেপুলেদের একটা করে দাও। আর বলো, যে আমার কানমলা দেবে, তাকে আরও একটা করে দেবো।’ এ হচ্ছে অহংকার নির্মূলের পদ্ধতি। অহংকার নিজে নিজে প্রতিরোধ করা যায় না। কারো সংস্পর্শে থেকে আত্মার চিকিৎসা নিয়ে প্রতিরোধ করতে হয়।
লেখক : পেশ ইমাম ও খতিব, বেদগ্রাম দক্ষিণপাড়া জামে মসজিদ, গোপালগঞ্জ