সফরনামা শিখধর্মের দেশে
সেরহিন্দ স্টেশনে পা রাখতেই একরকম হুড়োহুড়ি লেগে গেলো যাত্রীদের মাঝেÑকে কার আগে নামতে পারে! অন্যদের এড়িয়ে ধীরে ধীরেই এগোলাম বেরোবার পথে। ‘স্টেশন থেকে আরও আধঘণ্টার পথ দরগাহ।’ দেওবন্দ থেকে ফোনে এক বন্ধু জানালো তখন। সিএনজি মিলে গেলো বাইরে কদম ফেলতেই। জনপ্রতি বিশরুপি ভাড়া। দাম কষাকষির জোঁ নেই এ রাজ্যে। পাঞ্জাব শিখঅধ্যুষিত এলাকা। মুসলমানদের খাতিরদারি তেমন নেই বললেই চলে। ভয়-ডরে দেহ সিটে গেড়ে বসতেই ছুটে চললো সিএনজিটি। শিখধর্ম একটি সর্বেশ্বরবাদী ভারতীয় ধর্ম। পনেরোশো শতাব্দে ভারতীয় উপমহাদেশের এ অঞ্চলে গুরুনানক ধর্মটি প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে শিখগুরুদের মাধ্যমে এই ধর্ম প্রসার লাভ করে। তাদের সর্বশেষ গুরু হলো ধর্মগ্রন্থ ‘সাহিব’।
পথে পথে শিখ আর শিখ নজরে ভাসলো। বড় বড় গোঁফ, উঁচু উঁচু রঙিন পাগড়িÑঅন্যরকম মনে হলো। আসলে শিখধর্ম বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম ধর্মীয় গোষ্ঠী। সারাবিশ্বে এদের অনুগামীর সংখ্যা প্রায় তিন কোটি। পাঞ্জাবিভাষায় শিখধর্মের অনুগামীদের বলা হয় ‘শিখ’। যার বাংলা হলো ‘শিষ্য’। এরা ঈশ্বরে বিশ্বাস, মানব-মানবে ভেদাভেদহীন, ধর্ম-মতের বৈষম্যরেখাহীন, সাম্য-সমতায় বিশ্বাসী। পথের দু’ধারে নজর আটকালো হঠাৎ। দেখা মিললো শিখধর্মের অসংখ্য গুরুদ্বারার। সঙ্গে সাইনবোর্ডে লেখা পাঞ্জাবি হযবরল ভাষা। সহায়ক ভাষা হিসেবে কোথাও হিন্দি, কোথাও বা ইংরেজির মহরত। ‘আমরা যেমন ইবাদত করি, শিখরা তেমন উপসনা করেন, কীর্তন শোনেন, প্রার্থনা করেন; সকাল-সন্ধ্যে দু’বেলায়ই। আমাদের ইবাদতঘরের নাম মসজিদ, ওদের গুরুদ্বারা। মসজিদে যেমন ইমাম থাকেন, গুরুদ্বারায়ও তেমনি গুরু থাকেন।’ পাশের সিটের ভদ্রলোক থেকে এসব শুনে এগোতে এগোতেই চালকবাবু হঠাৎ ব্রেক কষে বসলো। মাথা বরাবর একটি সাইনবোর্ডও চোখে পড়লো। ইংরেজিতে লেখা ‘দরগাহ শরিফ’। একজন বললোÑ‘হাম আ গায়ে হে জী! উতরে।’ ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়লাম সবাই।
কাঁধের ব্যাগ গোছাতেই নাক বরাবর পড়লো বড় বড় উর্দু হরফ। লেখা ‘কুতুবে রাব্বানি মুজাদ্দিদে আলফে সানি (রহ.) কা রওজা শরিফ।’ এর ডানেই মোটা দাগে লেখা আয়াতুল কুরসি। বিড়বিড় করে পাঠ করতে করতে ঢুকলাম বড় আবেগে। হাঁটছি আর হাঁটছি। একে একে পেরোতে হচ্ছে ফটকের পর ফটক। প্রধান গেট পেরিয়ে সামনে এলো আরও দুটো ছোট দরোজা। প্রতিটার চারপাশেই ভবন, বাংলোয় ঘেরা মনোরম পরিবেশ। দেখতেও বেশ জমকালো। প্রথম ফটকের দু’পাশে রয়েছে শিখধর্মের অফিস কার্যালয়। সামনেও শিখদের বড় একটি গুরুদ্বারা নজরে এলো। আর দ্বিতীয় ফটকের দু’পাশে রয়েছে শ’খানেক কামরার দুটো ইমারত। প্রতিটার দরোজায় ভিন্ন ভিন্ন নম্বর লাগানো।
তৃতীয় ফটকের সামনেই সুবিশাল জামে মসজিদ। ক’জনকে দেখলাম নামাজ পড়ে বেরোতে। অনেককে আবার দেখা গেলো পাশের অজুখানায় অজু সারতে। হাতের দু’পাশেই জমকালো দুটো বাংলোয় চোখ আটকালো। জানতে পারলাম মোজাদ্দিদে আলফে সানি (রহ.)-এর বংশধরের নিবাস এটি। পূর্ব-দক্ষিণে রয়েছে আরও একটি ভবন। হাতের ইশারায় ভেতরে যেতে বললো একজন। রাজ দেখতে এগোলাম অন্দরে। দেখলাম বড় একটি কামরা। ওপরে লেখা ‘লঙ্গরখানা’। ভেতরে সাজানো বড়সাইজের পঞ্চাশটি নিচুটাইপ টেবিল। দু’পাশেই বসার জন্য বেশ কয়েকটি বিছানা পাতা। একসঙ্গে চারশোজনের খাবার খাওয়ার সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা। সবাই বসে খাবার খাচ্ছে দেখলাম। এককোণে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে একে একে। আরেকজন খাবারে ভর্তি প্লেট হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে। খাবার বলতে মুগডাল, দেহরাদুঁ চালের ভাত। সঙ্গে চাপাতি রুটি। ‘খাবারের পুরো ব্যবস্থা মাজার কর্তৃপক্ষের। বছরে একবার অল ইন্ডিয়া পীর পর্ষদের ওরস হয় এখানে। দূরদূরান্ত থেকে লোক আসেন। আর্থিক সহায়তা করেন। আর বাকি অর্থ এদের জমি-ক্ষেত থেকে আসে। সারাবছরই এখানে মুফতে থাকা-খাওয়া মেলে।’ জানালো এক ভদ্রলোক। খাবার শেষে এসে দাঁড়ালাম মসজিদের সামনে। পূবে লেখা ‘এন্ট্রিঘর’। কথা বললাম একজন পাঞ্জাবির সঙ্গে। রাতে থাকতে হলে আইডি দেখিয়ে কামরা নিতে হবে। কম্বল, বিছানা ফ্রিতেই মিলবে। আরও অজানা সব কানুন, সিস্টেম জানালো সে। রাতে সব সামান ঠিকঠাক হেফাজতে রাখতে হবে, একজনে সাবধান করলো। চুরিও হয়ে যেতে পারে বলে ভয়ও দেখালো খানিকটা। সাবধানবাণী শুনে এগোলাম কামরার পথে। বিশাল এলাকা। কামরা খোঁজা বড় মুশকিল। টানা মিনিট বিশেক এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করলাম। মিললো না। অবশেষে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম। পেছনদিকের আরেকটি ভবনের বি-সাইড দেখিয়ে দিলো সে। কদম কয়েক ফেলেই মিললো কামরা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম শেষমেষ। রাত তখন বেশ গড়িয়েছে। আর তেমন কিছু দেখা হলো না। হলো না হজরতজির কবর জেয়ারত করা। দোয়া-দরুদ পড়ে ঘুমরাজ্যে হারিয়ে গেলাম।
ভোরে চোখ যখন খুললো, তখন ফজরের জামাত আরম্ভ হবার উপক্রম। তড়িঘড়ি অজু সেরে শামিল হলাম জামাতে। নামাজ শেষে আবার ছুটলাম গুরুদ্বারায়। অভিনব অনেক কিছু দেখে দরগাহে ফিরতেই সূর্যটা বেশ রাঙিয়ে উঠেছে। হাতঘড়িতে তখন বেলা সাড়ে ন’টা। নাশতা সেওে বেরোলাম মাজার শরিফ ঘুরে দেখতে। গোটা দরগাহে সবমিলিয়ে নজরে পড়লো পনেরোটি ভবন, বাংলো। এর মাঝে তিনটে রয়েছে বেশ জমকালো। দেখার মতোন অনেকটা। অনেককে দেখলাম এপাশ-ওপাশ করতে। বসে বসে কোরআন পাঠ করছে কেউ বা। নানাজনে জিকিরেও সময় গড়াচ্ছে আশপাশে। হজরতের মাকবারা রয়েছে মসজিদের আরও পূর্ব-উত্তরে। অজুখানার পাশেই সমাধিক্ষেত্রের প্রধান ফটক। ওপওে দেখলাম বেশকিছু সতর্কবাণী। নারীদের ভেতরে যাওয়া নিষেধ, বাচ্চাদের সঙ্গে নেবেন না, ইত্যাদি। কে শোনে কার কথা! প্রধান ফটক টপকাতেই দেখলাম নারীদের বহর। হজরতের সমাধিক্ষেত্রে ঢোকার আগেই চারপাশে রয়েছে অজানা ত্রিশটে কবর। সেগুলোর ওপর আগরবাতি জ্বালাচ্ছিলো তারা? নজর আটকালো গম্বুজেঘেরা আলাদা একটি ঘরে। গেটে লেখা হজরতজির নাম। অতি আগ্রহে কদম রাখলাম ভেতরে। এখানেও চোখে পড়লো মা-বোনদের। কোরআন শরিফ হাতে বসে রয়েছে তারা। কেউ বা তাবিজ, জলের বোতল, তেলের শিসি নিয়ে কবরের পাশে যাবার প্রস্তুতিও নিচ্ছে। ভিড় ঠেলে এগোলাম সামনে। দেখলাম ক’জন দু’হাত তুলে প্রার্থনা করছে। হজরত মোজাদ্দিদে আলফে সানি (রহ.)-এর কাছে, নাকি মহান রাব্বে কারিমের দরবারে! হেঁড়ে মাথায় ঢুকলো না কিছুই। একে একে লাইন পেয়ে গেলাম। প্রাণভরে সালাম দিলাম ভেতরে ঢুকে। সুরা ফাতিহা, চারকুল, আয়াতুল কুরসি পাঠ করলাম চোখ বুজে বুজে। নজর বুলাচ্ছিলাম এদিক-ওদিক। কবরের ওপরে রয়েছে বিশেষ কিসিমের ঝাঁড়বাতি। হজরত মোজাদ্দিদে আলফে সানি (রহ.)-এর পাশেই শুয়ে আছেন তাঁর দুই ছেলে। বড় বুজুর্গ ছিলেন তাঁরাও। নাম হজরত খাজা আহমদ (রহ.) ও খাজা সাঈদ (রহ.)। দরগাহের অপর পাশে আলাদা করে রয়েছে হজরতের তৃতীয় ছেলের কবর। যাঁর কাছে জেলে থাকতে তিনি চিঠি লিখেছিলেন একবার। নাম খাজা মাসুম (রহ.)। হজরতের কবরের পাশে চোখে পড়লো একটি রুপির বাক্স। কবর জেয়ারত করে সবাইই কিছু না কিছু ফেলে যায় তাতে। কেবল ফেলা হলো না আমার। সোজা বেরিয়ে পড়লাম বাইরে।
মাকবারার পশ্চিমদিকটায় নজরে পড়লো একজন বাংলাদেশি বুজুর্গের কবর। হজরতের বিশেষ খলিফা ছিলেন নাকি তিনি। ঢাকায় তাঁর জন্ম। কীভাবে যেনো এখানে তাঁর ওফাত হয়। ফলে তাঁর কবরটিও এখানে রয়ে গেছে। কবরটি জেয়ারত করে পা ফেললাম সমাধিক্ষেত্রের দ্বিতীয়তলায়। ওপর থেকে দেখতে লাগলাম পুরো দরগাহ এলাকা। সময় তখন মধ্যদুপুরে গড়াতে লাগলো প্রায়। হাঁটা ধরলাম মসজিদের উদ্দেশ্যে। মসজিদে হঠাৎ আজান পড়ে গেলো হজরতও এই জুমাবারেই ১৫৬১ খৃস্টাব্দ মোতাবেক ৯৭১ হিজরির ১৪ শাওয়াল দিনগত রাতে জন্মগ্রহণ করেন। আবুল বারাকাত তাঁর উপনাম। বদরুদ্দিন তাঁর উপাধি। জন্মের প্রায় চারশো বছর আগে প্রসিদ্ধ অলি হজরত শায়খ আহমদ জাম (রহ.) তাঁর নাম রাখেন ‘আহমদ’। জন্মের সময় তাঁর শ্রদ্ধেয়া মা অদৃশ্য আওয়াজে জানতে পারেন বিষয়টি। পিতা হজরত শায়খ আবদুল আহাদ (রহ.) ছিলেন মুসলিমবিশ্বের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রা.)-এর সাতাশতম অধস্তন পুরুষ।
‘হে আল্লাহ, উমর ইবনে খাত্তাব অথবা আবু জেহেলের মাধ্যমে ইসলামকে শক্তিশালী করো।’ রাসুল (সা.) একবার এই দোয়া করেছিলেন। মহানবী (সা.)-এর সেই দোয়া হজরত উমর (রা.)-এর মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। তাঁর খেলাফতকালেই ইসলাম উন্নতির উচ্চশেখরে পৌঁছে। রাসুল (সা.)-এর ওফাতের হাজার বছর পর যখন পৃথিবীময় ফের শিরক, বেদাত, কুফরির সয়লাব হলো, তখন হজরত উমর (রা.)-এর বংশধর হজরত মোজাদ্দিদে আলফে সানি (রহ.)-এর মাধ্যমে ইসলাম আবার শিরক, বেদাতমুক্ত হয়। বিশেষভাবে বাদশাহ আকবরের দীন-ই এলাহিকে চিরতরে নিঃশেষ করবার অবদান হজরতেরই। বিশ্বময় ইসলামের আলো ছড়িয়ে ১০৩৪ হিজরির ২৮ সফরে অবশেষে তিনি সাড়া দেন রাব্বে কারিমের ডাকে। এসব বর্ণনা চোখের তারায় ভেসে উঠতেই মনে পড়ে গেলো তাঁর বাবা-মায়ের কথা। দরগাহের অদূরেই তাঁদের কবর। তবে এক জায়গায় নয়, আলাদা আলাদা এলাকায়। জুমাবাদ টেম্পুতে চড়ে প্রথমে গেলাম মায়ের সমাধিতে। জেয়ারত করলাম ভক্তিভরে। ফের মিনিট বিশেক পথ পেরিয়েই পৌঁছুলাম তাঁর বাবার মাকবারায়। সূর্য তখন মাথার ওপর। রোদের তাপও সহ্যসীমা ছাড়িয়েছে অনেকটা। সালাম দিয়ে ভেতরে ঢুকেই তড়িঘড়ি মোনাজাতটুকুন সেরে নিলাম।
লেখক : শিক্ষক, গওহরডাঙ্গা মাদরাসা, টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ।