এ কেমন অভ্যর্থনা, এ কেমন সংবর্ধনা ?
বিদেশ সফরে বিশেষ কিছু অর্জন কিংবা বিশেষ কোনো স্বীকৃতির জন্য গণসংবর্ধনা কিংবা অভ্যর্থনা অবশ্যই দেওয়া যেতে পারে। অথচ কী হচ্ছে এখানে? দিনে দিনে কেমন সব অপসংস্কৃতির স্তুপ জমছে একের পর এক! এক নেত্রী বিদেশ থেকে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরবেন। তাকে জানাতে হবে অভ্যর্থনা। নেতা-কর্মীদের শো-ডাউন, মোটর সাইকেল মিছিল, শত শত গাড়ির বহর, রাস্তার দু-পাশে দলীয় হাজার হাজার নেতাকর্মীর অভিবাদন। আরেক নেত্রী সরকারি সফরে বিদেশ যাবেন। বিদেশ থেকে দেশে ফিরলেই সম্বর্ধনা। রাস্তা ঘাট আটকে সেই একই দৃশ্য। অসংখ্য নেতাকর্মীর সমাগম। শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত দিগি¦দিক।
সেই মুখরিত কোলাহলে চাপা পড়ে থাকে অসংখ্য মানুষের গোঙানী, অসুস্থ মানুষের ছটফটানী, কর্মব্যস্ত মানুষের দীর্ঘশ্বাস-দুশ্চিন্তা। ঢাকা শহর এখন স্বাভাবিক অবস্থাতেই চলাচলের অনুপযোগী। সেখানে অভ্যর্থনার নামে, সংবর্ধনার নামে দলীয় হাজার হাজার নেতাকর্মীর ¯্রােতে লাখ লাখ মানুষের যে ভোগান্তির সৃষ্টি, তা কি কারোর বিবেচনায় আসে না? এই অভ্যর্থনা আর সংবর্ধনার নামে দলীয় হাইব্রীড-কাউয়া-দলকানা-চামচা-চ্যালা চামু-ারা সত্যি সত্যিই আনন্দে ডগমগো না হলেও হবার ভান করবে, দলীয় হাইকমা-ের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। কিন্তু দুঃসহ যন্ত্রনার মধ্যে কর্মমুখী আর অসুস্থ মানুষ, স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীরা কি কখনো ভালোভাবে গ্রহণ করে তা? আমাদের নেতা-নেত্রীরা কি ভেবে দেখেছেন কখনো? দীর্ঘ সময়জটে কতো অসংখ্য ক্ষুধার্ত শিশু যে যন্ত্রনায় ছটফট করে, হাসপাতালে পৌঁছানোর কপাল না থাকায় অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যেই যে কতো মুমূর্ষু মানুষ ভালোবেসে মৃত্যুকেই কাছে টেনে নিচ্ছে, তার কি হিসেব রাখেন কেউ!
গণমাধ্যমেও কি উঠে আসে সবার কথা! আমাদের বুঝতে কষ্ট হয় না, এই অভ্যর্থনা-সংবর্র্ধনা এগুলোর সবই লোক দেখানো, শো-ডাউন, এক দলকে দেখিয়ে আরেক দলের জনপ্রিয়তা প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা। আমরা জানি, দুই নেত্রীর ভক্ত অনুরাগীর সংখ্যা অসংখ্য। তারা না কি তাদের কাছের, প্রাণের চেয়ে প্রিয়! আবার সেই নেত্রীরাও না কি রাজনীতি করেন শুধু মানুষের জন্যই। কিন্তু সেই অগণিত অনুরাগীই কি ষোল কোটি জনতার সবাই? তাহলে ওই যে যাদের সবকিছু স্থির হয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, জীবন থমকে থাকে যাদের অদ্ভুত অনিশ্চয়তায়, তারা কোথাকার মানুষ? সবাই কি নেতা-নেত্রীদের সব ধরনের অত্যাচার ভালবেসে মেনে নেয়ার জন্য প্রস্তুত?
এক নেত্রী দেশে ফিরলে বিমানবন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানানোর আয়োজনকে কেন্দ্র করে দুপুরের পর থেকে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজটের। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকে বিভিন্ন ধরনের যানবাহন। সেই জানজটের লেজ গিয়ে পড়ে বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তায়, আর এপাশেতো রয়েছেই।
চার/পাঁচ ঘণ্টা এক জায়গাতেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে হাজার হাজার গাড়ি, লাখ লাখ মানুষ। দেখার যেনো কেউ নেই অসহায় মানুষগুলোকে। কারোর মুখের দিকে তাকানোর উপায় নেই। হাসফাঁস সবারই। অগত্যা বাস থেকে নেমে দুপায়ে ভরসা করে গন্তব্যের দিকে যাত্রা। কিন্তু সেই দুপায়েও যেন স্বস্তি মেলে না। ফুটপাথও যে দলীয় নেতাকর্মীদের দখলে। তার মধ্য দিয়েই হাজার মানুষের ভীড়ে যেন এক চিলতে পথ খুঁজে নিতে প্রাণান্ত চেষ্টা ওষ্ঠাগত জীবনের। একটি পত্রিকায় এমন এক অসহায় মানুষের মন্তব্য, ‘এই দেশ আমাদের জন্য না। রাজনীতিবিদ আর সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য এই দেশ।’
মাত্র ক’দিন আগেই ইন্দোনেশিয়ার একটি খবর চোখে পড়ল। সামরিক বাহিনীর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণ করার কথা ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি জোকো উইদোদোর। যানজটে আধা ঘণ্টা আটকে থাকার পর গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা শুরু করে দিলেন রাষ্ট্রপতি। দুই কিলোমিটার পথ পায়ে হাঁটার পর তিনি যোগ দেন কুঁচকাওয়াজে। অন্য কোনো দেশের নেতা-নেত্রীরা যানজটের কারণে নিজেরাই হেঁটে চলে যান গন্তব্যে, আর আমাদের দেশের নেতা-নেত্রীদের জন্য যানজট এখন জীবনের অনুষঙ্গ। এমন পার্থক্য আরও কতো কিছুতে!
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা : আশিক রহমান ও মোহাম্মদ আবদুল অদুদ