সেবকের অমানবিকতা
যিশু খ্রিস্টের জন্মেরও ৪০০ বছর আগে গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস চিকিৎসা পেশায় নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধের শপথ লিখে গিয়েছিলেন। সেটার আধুনিক সংস্করণ আজও চালু আছে। সেখানে বলা আছে, হৃদ্যতা, সহমর্মিতা দিয়ে রোগীদের কথা শুনে, তাদের সমস্যা উপলব্ধি করা শল্য চিকিৎসকের ছুরি বা রসায়নবিদের ওষুধের চেয়ে বেশি কার্যকর। চিকিৎসা শিক্ষায় সেই শপথ পাঠ করানোর রেওয়াজ বাংলাদেশেও রয়েছে। তবে পেশায় ঢুকে তা মনে রাখেনÑ এমন ডাক্তারের দেখা এ দেশে খুব কম রোগীই পায়। ডাক্তারের মমত্ববোধে মুগ্ধ হওয়ার বদলে দুর্ব্যবহারে ভীত হওয়ার অভিজ্ঞতাই রোগীদের বেশি। এ দেশে চিকিৎসা নিতে গিয়ে ডাক্তারদের দুর্ব্যবহারের মুখে রোগীদের অসহায় হয়ে পড়ার ঘটনা ঘটছে অহরহ। এমনই একটা ঘটনা উল্লেখ করছি, ষাটোর্ধ্ব গরিব মহিলা রোগী ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়ায় রোগীকে দেখার পর ডাক্তার ব্যবস্থাপত্র লিখে দিয়ে বলল, ভিজিট দিন। গরিব অসহায় রোগী অনেক কষ্ট করে মানুষের দারস্থ হয়ে আনা তিনশ’ টাকা ডাক্তারের হাতে দিলেন। ডাক্তার ওই টাকাটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন এবং ব্যবস্থাপত্রটা নিয়ে ছিঁড়ে দিয়ে রোগীকে বের করে দিলেন। অসহায় গরিব মহিলা ডাক্তারের হাতে পায়ে ধরেও কোনো বিহিত করতে না পেরে কান্না করতে করতে বেরিয়ে গেলেন। এই যদি চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত সেবকগণের অবস্থা হয় তাহলে অসহায় মানবতা ধুঁকে ধুঁকে মরবে। এ ঘটনাটি পড়ে হয়তো পাষাণ হৃদয়ের অধিকারী ব্যক্তিটিও আঁতকে উঠবেন কিন্তু তাদের কিছু যায় আসে না। পড়াশোনা করতে অনেক টাকা গুণতে হয়েছে, আজ সুদে আসলে নেওয়ার পালা।
অসহায় রোগীদের এই আক্ষেপ ও আহাজারি চিকিৎসক সমাজের কানে পৌঁছায় কি-না বা পৌঁছলেও তাদের ভেতরে এতটুকু নাড়া দিতে পারে কি-না, আমার জানা নেই। তবে অসহায় এসব মানুষের আক্ষেপ আমাদের মনের ভিতর গভীর এক নাড়া দিয়ে যায়।
আমরা জানি, ডাক্তারি পেশাটি মানুষের সেবা করার মতো অসাধারণ এক মহান পেশা। যে পেশার মানুষরাই পারে আল্লাহর রহমতে একজন মুমূর্ষু মানুষকে নতুন জীবন দিতে। পারে অসংখ্য অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে। কিন্তু সময় গড়ার সাথে সাথে এ পেশার মানুষের সংখ্যা বাড়লেও তাদের মানবিক বোধ যেন দিন দিন কমছে। অবশ্য এর ব্যতিক্রমও রয়েছে।
যথেষ্ট আন্তরিক, মানবিক ও বিবেকবোধ সম্পন্ন চিকিৎসকও এ সমাজে রয়েছেন। যারা সেবার মানসিকতা নিয়েই পেশাটিকে বেছে নিয়েছেন এবং এখনো নীরবে সাধারণ ও অসহায় মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন। যাদের কাছে চিকিৎসা পেশাটি কেবলই অর্থ বানানোর হাতিয়ার নয়। তবে এ সংখ্যা আনুপাতিক হারে অতি নগণ্য।
কেউ অসুস্থ হলে রোগীর স্বজনরা দিশেহারা হয়ে যান। কিন্তু এ অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ডাক্তার রোগীর স্বজনদের অভয়ের পরিবর্তে এমন ভাব দেখান রোগীর সাথে সাথে স্বজনদেরও প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে। উঁচু তলার মানুষ ছাড়া এমন মানুষ পাওয়া যাবে না যারা এ ধরনের বিড়ম্বনার শিকার হয়নি।
সরকারি হাসপাতালে ভালোভাবে রোগী দেখার আর সময় আছে? সবার তো আছে প্রাইভেট ক্লিনিক।
হাসপাতালে সেবা নিতে আসা গরিব ও অসহায় মানুষদের সেবা দিতে কুণ্ঠিতবোধ করলেও নিজের নামের শেষে ওই প্রতিষ্ঠানের পদবি ব্যবহার করতে সংশ্লিষ্ট ডাক্তাররা এতটুকু কুণ্ঠিত নন। কারণ, এই পদবিই তার সাইনবোর্ড। এই পদবির জোরেই তার প্রচার। পদবি যত বড়, ডাক্তার হিসেবে তিনি ততটাই বড় বিশেষজ্ঞ।
লেখক : শিক্ষক, ইকরা স্কুল এন্ড কলেজ
সম্পাদনায় : খন্দকার আলমগীর হোসাইন