বিশ্ব শিক্ষক দিবসে অঙ্গীকার
সারা পৃথিবীতে সবার জন্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশের রূপকার হিসেবে শিক্ষকদের অবদান স্মরণ করার জন্য ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হয়ে থাকে। সেই সঙ্গে, এ বছর উচ্চশিক্ষার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ইউনেস্কো কর্তৃক সুপারিশমালা প্রণয়নের ২০ বছর পূর্তি উৎসব পালিত হতে যাচ্ছে। সেজন্য, ইউনেস্কো বিশ্ব শিক্ষক দিবসের এ বছরের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘স্বাধীনভাবে পাঠদান, শিক্ষক হবেন ক্ষমতাবান’।
এদিকে, নোবেল শান্তি বিজয়ী কৈলাস সত্যার্থী গত ২ এপ্রিল ঢাকায় ‘দশ কোটি শিক্ষা বঞ্চিত মানুষের জন্য আমরা দশ কোটি, আমাদের ভবিষ্যৎ আমরাই গড়বো’ শীর্ষক এক শপথ ক্যাম্পেইন উদ্বোধন করেন। এটি নিয়ে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর, নিরাপদ ও স্বাক্ষরসমাজ গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে গণস্বাক্ষরতা অভিযান, বাংলাদেশ। তারা সব সহযোগী সংগঠন নিয়ে ৫ অক্টোবর ২০১৭ বিশ্ব শিক্ষক দিবস উপলক্ষে আয়োজিত বিভিন্ন কর্মসূচিতে এই ‘শপথ’ বাক্য পাঠ করানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবস উপলক্ষে ইউনেস্কোর মহাসচিব ইরিনা বোকোভা তার বাণীতে বলেন, দেশে দেশে একাডেমিক স্বাধীনতা ও শিক্ষকদের স্বায়ত্তশাসন হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। তিনি উদাহরণ দিয়েছেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে কঠিন বাধ্যবাধকতার মাধ্যমে স্টান্ডার্ড পরীক্ষা নেওয়া হয়। সামগ্রিক শিক্ষাক্রম ও শিক্ষার্থীদের বিভিন্নমুখী চাহিদা উপেক্ষা করে শিক্ষকদের প্রতিনিয়ত পরীক্ষা নেওয়ার কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষকেরা তাদের স্বায়ত্তশাসন ভোগ করতে পারেন না।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষার সব স্তরেই একাডেমিক স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের উদ্ভাবনী দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ ও গবেষণা কাজে মনোনিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এবছর বিশ্ব শিক্ষক দিবস উপলক্ষে এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল-এর উপ-সাধারণ সম্পাদক ডেভিড অ্যাডওয়ার্ড ইউনেস্কো সদর দপ্তরে বলেন, উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষকদের পেশাদারিত্ব, একাডেমিক যোগ্যতা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা থেকে নিয়োগকারী ও বিনিয়োগকারীরা ‘শিক্ষকদের স্বাধীনতা’কে মুক্তি দিয়েছেন। অন্যদিকে আরেক দল লোক বিভিন্ন দেশের সরকারকে বোঝাচ্ছেন, শিখন-শেখানো কার্যক্রম আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে প্রাইভেট কোম্পানির কাছ থেকে ক্রয় করা যেতে পারে। যেখানে শুধু কম্পিউটার অ্যাপসের মাধ্যমে সস্তায় শিক্ষাদান করা সম্ভব হবে। সেই শিক্ষায় প্রয়োজন হবে না কোনো পেশাদারীত্বের। এবছর গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনিয়মিত শিক্ষকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব অধ্যাপকের মাত্র এক-চতুর্থাংশ সরকারি অনুদান লাভ করেন। বাকি অধিকাংশকেই কোনো বাসায় নয়, গাড়িতে রাত্রি যাপন করতে হয়। সে দেশে উচ্চ শিক্ষায় নিয়োজিত ৭৫ শতাংশ শিক্ষক ট্যানিউর বহির্ভূত। দক্ষিণ আমেরিকায় এই হার ৮০ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ায় ৪০ শতাংশ এবং কানাডায় ৩০ শতাংশ ভাগ। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের এসব অনিয়মিত শিক্ষকের একাডেমিক স্বাধীনতা অত্যন্ত ভঙ্গুর। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা বেড়ে যাওয়ার কারণে ঐ সকল ক্যাম্পাসে অল্প বেতনে শিক্ষক নিয়োগের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসকল কর্পোরেট ক্যাম্পাসে শ্রম আইন মানা হচ্ছেনা। কানাডা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি এক গবেষণায় দেখিয়েছে, অনিয়মিত অধ্যাপকেরা শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ও গবেষণার কাজে সহযোগিতার ক্ষেত্রে অনেকটাই অপারগ। আয়ের জন্য দীর্ঘসময় ধরে কাজ করে, এবং কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদানে নিয়োজিত থাকার কারণে তারা শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় সময় দিতে পারেন না। চাকুরির নিম্ন মর্যাদার কারণে তারা এমনকি কোনো শিক্ষার্থীকে সুপারিশ পত্র বা কাউকে গবেষণা রিপোর্টের ডিফেন্স পর্যায়ে সহযোগিতা করতে পারেন না। ১৯৬৬ সালে ইউনেস্কো/আইএলও কর্তৃক প্রণীত সুপারিশমালায় দেখা যায়, দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার ক্ষেত্রে নিয়োগ পর্যায়ে পেশাদারিত্বের মান বজায় রাখার জন্য শিক্ষকদের মতামত গ্রহণ করা প্রয়োজন। বর্তমানে শিক্ষকদের এই পেশাগত স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন না থাকার কারণে অনেক দেশে সরকারগুলো মানহীন শিক্ষক দিয়ে স্বল্প খরচে শিশুদের লেখাপড়ার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। যার দরুন এই সব শিক্ষার্থীরা দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে উঠতে পারছে না।
লেখক : অধ্যক্ষ, শেরপুর সরকারি কলেজ, শেরপুর
সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ ও খন্দকার আলমগীর হোসাইন