সম্পর্কের সমাপ্তি এবং পারিবারিক সহিংসতা
ডা. জাকির হোসেন
গত কয়েকদিনে বেশ কটি নৃশংস ঘটনা পত্রিকার পাতায় বেশ আলোচনা হচ্ছে। প্রতিটি ঘটনা বিবেকবান দেশবাসীর হৃদয়কে বেশ নাড়া দিয়েছে। এর মধ্যে একটি ঘটনা কুমিল্লায় স্বামী তার স্ত্রীকে হাত পা বেঁধে দরজা আটকে গায়ে অকটেন ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে। আরেকটি ঘটনা রাজধানী ঢাকা মোহাম্মদপুরে টুম্পা নামে এক নারীকে তার সাবেক স্বামী দোকানে ঢুকে দিনে দুপুরে কুপিয়ে হত্যা করে। মানুষ পৃথিবীতে বেঁচে আছে তার সম্পর্কের কারেণেই। জীবন থাকলে সম্পর্ক থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আবার সম্পর্ক আজীবন একইরকম থাকবে বা বেঁচে প্রাণবন্ত থাকবে এমনটা সর্বক্ষেত্রে আশা করা যায় না। সমাজ-সংসারে মানুষ প্রেমের বন্ধন, আত্বার বন্ধন, রক্তের বন্ধন সহ নানা রকম সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ। নানা ধরনের সম্পর্কের মাঝে এক সময় হৃদয়ের বন্ধনটা যেমন শক্তিশালী ছিল ঠিক তেমনি সম্পর্কের টারমিনেশনে জটিলতাও অনেক কম ছিল। যুগের সাথে পাল্লা দিয়ে পরিবর্তন এসেছে সর্ম্পক তৈরিতে থেকে শুরু করে এক বুকে ধারন করার মাধ্যমেও। আজকাল ঘরে বসেই পৃথিবীর এক প্রান্থ থেকে অন্য প্রান্থে আরেক জনের সাথে মানুষ সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে। আবার অতীতের মত এখনো অনেক দেখেশুনে বিয়ের মত ধর্মীয় সম্পর্ক সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু কোনা পন্থায়ই বন্ধনকে পুত পবিত্র রাখা আগের মত সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিনিয়ত ভাঙ্গছে সর্ম্পক, তৈরি হচ্ছে জটিলতা। জটিলতার পরবর্তী পর্যায়ে এখন বাড়ছে সহিংষতা, নৃশংষতা। প্রশ্ন হলো কেন আজ সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না? সহজে উত্তর দেওয়া একেবারেই দুঃসাধ্য। বিশ্বায়নের এই যুগে কোন জাতি বা দেশ কোনোক্রমেই নিজেকে বিশ্ব পরিম-ল থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে পারবে না। বাঙালি জাতির নিজস্ব সংস্কৃতিও আজ বিজাতীয় সংস্কৃতির সাথে পাল্লা দিয়ে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারছে না। তাছাড়া অন্য জাতির কৃষ্টি কালচার নকল করে নিজের সংস্কৃতিতে চালিয়ে দেওয়ার বদনাম আমাদের অনেক আগে থেকেই আছে। প্রশ্ন হলো সেই কালচার নকল করার সততা কতটুকু আমাদের নতুন জেনারেশন পাচ্ছে। পশ্চিমা কালচারের শতভাগ কলষিত নয়। ওখানে অনুকরণ এবং অনুসরণ করার মত অনেক ভাল কৃষ্টি কালচার পরিলক্ষিত হয়। কিছুদিন আগেও বেশ কিছু পত্রিকার শিরোনাম ছিল ইউরোপের অনেক শহরে কারাগার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে অপরাধী পাওয়া যায় না বলে। পশ্চিমা কালচারে বিচ্ছেদের যে রীতি চলে আসছে তা বিশ্বের সব দেশের জন্যই অনুকরণীয়। বিচ্ছেদ হলেও তারা সারা জীবন একে অপরের ভাল বন্ধু হিসেবে ছায়ার মত পাশে থেকে যাচ্ছে। অনেক সবচেয়ে বিচিত্র হলো আমাদের মানুষের মন। তার চেয়ে বেশি বিচিত্র হলো মানুষের প্রেম। খানিকটা চোখের পলকে, হঠাৎ পথের দেখায় কখন কোথায় কীভাবে সে প্রেমে পড়ে যায়, মানুষ নিজেও কোনো কিছু বুঝে উঠতে পারে না, মানব মস্তিষ্কের লিম্বিক সিস্টেমের এই আবেগীয় খেলায় তার বৈচিত্রের হদিস মেলা ভার। বিজ্ঞানের এই উন্নতির যুগেও গা ভাসিয়ে চলছে বাঙালি সমাজ। আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজনীয় শিক্ষা যেন সমাজ থেকে একেবারেই হারিয়ে গেছে। সম্পর্কের যেমন সৃষ্টি হয় আবার তার টারমিনেশনও জীবনের প্রয়োজনে হতে পারে। মানুষের রুচি এবং পছন্দের পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কের ভেঙে যাওয়ার একটা বিশাল যোগ সূত্র আছে। তাছাড়া মানুষের সবার সত্বাও একরকম নয়। কখনোই দুজন মানুষের সবকিছু শতভাগ এক সাথে মিলে যেতে পারে না। এই বৈষম্য মেনে নিয়েই সম্পর্কে জড়ানোর দীক্ষাটুকুও যেন আজকের জেনারেশন কোথাও থেকে পাচ্ছে না। বিষয়গুলো এখন বেশ জটিল আকার ধারন করেছে এর অন্যতম কারণ হচ্ছে সর্ম্পক ভেঙে যাওয়ার পর পারিবারিক ও সামাজিকভাবে কাউকে সাইকোলজিক্যাল সাপোর্ট দেওয়ার অভাবেই। সর্ম্পক গড়ার সময় দুটি প্রাণে যে মধুমাখা আবেগ লক্ষ্য করা যায়, সম্পর্ক ভাঙনের ক্ষেত্রেও যেন একটি প্রত্যাশিত ব্যবহার দুটি প্রাণ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ফুটে ওঠে সে ব্যপারে প্রতিটি পরিবারকে অনেক বেশি ভূমিকা রাখার সময়ের প্রয়োজন হিসেবে দেখা দিয়েছে।
লেখক : চিকিৎসক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা : আশিক রহমান