রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশ কোন পথে?
রোহিঙ্গা সংকটটি বহুমাত্রিক এবং জটিল। অন্তত ছয়টি মাত্রা যোগ করা যায় এই সংকট বিবেচনার সময়। এক. মানবিক। দুই. বাংলাদেশ-মিয়ানমার কূটনৈতিক আন্তঃসম্পর্কে টানাপড়েন। তিন. বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব। চার. বাংলাদেশ-মিয়ানমার এবং এই অঞ্চলের নিরাপত্তার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব। পাঁচ. গোটা অঞ্চল উগ্রবাদী হয়ে ওঠার পরিপূর্ণ আশঙ্কা রয়ে গেছে যদি না এই সংকটটি দ্রুত নিরসন হয়। ছয়. বাংলাদেশের যে অঞ্চলগুলোতে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে সেই অঞ্চলগুলোর পরিবেশগত বিপর্যয়। সুতরাং বাংলাদেশকে একদিকে যেমন এই সংকট নিরসনের জন্য কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হচ্ছে একই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার কারণেই যে সংকটগুলো তৈরি হয়ে আছে সেগুলো সম্পর্কেও সচেতনতা কাম্য বলেই মনে করি।
বাংলাদেশ এ পর্যন্ত তার কূটনৈতিক উদ্যোগের দুটি পর্যায়ে নির্দেশ করেছে। প্রথমত, মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগ, আলোচনা এবং সম্ভাব্য সমাধানের জন্যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে জাতিসংঘকে সচেতন করা। এই প্রসঙ্গে আমরা আরেকটু লক্ষ্য করেছি যে, অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে রাশিয়াতে পাঠিয়েছে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করার জন্য। জানা আছে যে, এই রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানের ক্ষেত্রে বড় রকমের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রেখেছে অন্তত তিনটি রাষ্ট্র। তার মধ্যে প্রধানত রাশিয়া, চীন এবং প্রকারান্তরে ভারত। রাশিয়া এবং চীন দুটো রাষ্ট্রই ভূ-অর্থনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক কারণে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমরা জানি যে, রাশিয়া মিয়ানমারের কাছে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র বিক্রেতা। অন্যদিকে চীন রাখাইন অঞ্চলে যে খনিজ সম্পদ আছে তার সরাসরি সুবিধাভোগী। এই রাখাইন অঞ্চলে ২০০৪ সালে প্রচুর খনিজ সম্পদ আবিষ্কৃত হয়েছে। এই খনিজ সম্পদের মধ্যে আছে তেল, গ্যাস আর পৃথিবীর সর্বোচ্চ মানের ইউরেনিয়াম। ইতোমধ্যেই কুনমিং পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ করছে চীন এই রাখাইন রাজ্য থেকে। ভারতের বেশকিছু অর্থনৈতিক প্রকল্প রয়ে গেছে রাখাইন এলাকায়। সুতরাং এই তিনটি রাষ্ট্র সমন্বিতভাবে তাদের যে নীতি অনুসরণ করছে তার পেছনে ভূ-রাজনীতি এবং ভূ-অর্থনীতি বড় ভূমিকা পালন করছে বলে মনে হয়। তবে বাংলাদেশের উচিত হবে এইটুকু বোঝানো যে রোহিঙ্গা সংকট যদি চলমান থাকে, যদি নিরসন না হয় তাহলে ক্রমাগতভাবে এই অঞ্চলটি উগ্র হয়ে উঠবে, সহিংস হয়ে উঠবে, অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে এবং তার ফলে এই এলাকায় কোনো ধরনের অর্থনৈতিক প্রকল্পের ভবিষ্যৎ চিন্তা করা যায় না। বাংলাদেশ এই উদ্যোগ অতি সম্প্রতি গ্রহণ করেছে। সে জন্য আমরা মনে করি যে বাংলাদেশের কূটনীতি সঠিক পথেই আছে। কারণ বাংলাদেশ কূটনীতির বিকল্প কিছু এই মূহুর্তে ভাবছে না।
প্রসঙ্গক্রমে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। আমরা জানি তিনি অতি সম্প্রতি জাতিসংঘ সফর করে এসেছেন এবং জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তার পাঁচ দফা প্রস্তাবের আগেই তিনি ১৯ সেপ্টেম্বর অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন-এর কন্ট্রাক্ট গ্রুপের সঙ্গে সভায় ছয় দফা প্রস্তাব তিনি পেশ করেছেন। প্রস্তাবগুলো ছিল এক. রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সব ধরনের নিপীড়ন বন্ধ করতে হবে। দুই. নিরাপরাধ বেসামরিক জনগোষ্ঠী বিশেষ করে নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য মিয়ানমারের ভেতরে নিরাপদ এলাকা প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে যেখানে তাদের সুরক্ষা দেওয়া হবে। তিন. বল প্রয়োগের ফলে বাস্তুতচ্যুত সব রোহিঙ্গা যেন নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে মিয়ানমারে তাদের বাড়িতে ফিরতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। চার. রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে কফি আনান কমিশনের পূর্ণাঙ্গ সুপারিশ অবিলম্বে নিঃশর্তভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। পাঁচ. রোহিঙ্গাদের বাঙালি হিসেবে চিহ্নিত করার যে রাষ্ট্রীয় প্রচারণা মিয়ানমার চালাচ্ছে তা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। ছয়. রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে না ফেরা পর্যন্ত তাদের জরুরি মানবিক সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে হবে ভ্রাতৃপ্রতীম মুসলিম দেশগুলোর। বোধগম্য যে, প্রস্তাবগুলো বেশ ব্যাপক এবং অত্যন্ত অর্থবহ; এবং এই প্রস্তাবের সঙ্গে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব আমরা পেয়েছি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পাঁচ দফা প্রস্তাব তুলে ধরেন। তিনি প্রথমত বলেছেন অনতিবিলম্বে এবং চিরতরে মিয়ানমারের সহিংসতা ও জাতিগত নিধন নিঃশর্তে বন্ধ করা। দ্বিতীয়ত, অনতিবিলম্বে মিয়ানমারে জাতিসংঘের মহাসচিবের নিজস্ব একটি অনুসন্ধানী দল প্রেরণ করা। তৃতীয়ত, জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সব সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান করা এবং এই লক্ষ্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষা বলয় গড়ে তোলা। চতুর্থত, রাখাইন রাজ্য থেকে জোড়পূর্বক বিতাড়িত সব রোহিঙ্গা মিয়ানমারে তাদের নিজ ঘর-বাড়িতে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা। পঞ্চমত, কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালা নিঃশর্ত, পূর্ণ এবং দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। সামগ্রিক বিচারে বলা যায় যে, ছয় দফা এবং পাঁচ দফা প্রস্তাব দুটো চেতনাগতভাবে এবং লক্ষ্যের বিচারে প্রায় অভিন্ন, আর একই সঙ্গে এটাও উল্লেখ করতে হবে যে, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের সামগ্রিক দিক নির্দেশনা এই দুটো প্রস্তাবনার মধ্যে আছে।
বাংলাদেশ এ যাবত রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে যে উদ্যোগগুলো গ্রহণ করেছে সেগুলো বিকল্পহীনভাবে যথার্থ বলে আমাদের কাছে মনে হয়েছে। বাংলাদেশকে মনে রাখতে হবে, সংকটটি চট্জলদি সমাধান হওয়ার নয়। একটি দীর্ঘমেয়াদি সংকটের আবর্তে পড়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সেজন্যে বাংলাদেশের উচিত হবে যখন কূটনৈতিক পন্থা চলমান থাকবে তারই সমান্তরালে এই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য আর্ন্তজাতিক সাহায্য-সহযোগিতা যতদূর বেশি আদায় করা যায়। গণমাধ্যম থেকে জানা যায় যে, প্রয়োজনীয় সাহায্যের মাত্র ২৪ শতাংশ আশ্বাস ও নগদে পাওয়া গেছে। সুতরাং রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক কূটনীতিও পরিচালনা করতে হবে। অর্থাৎ একটি বহুমুখী সমস্যা মোকাবিলা করার জন্যে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : ইতিহাসবিদ