প্রাকৃতিক দুর্যোগ বনাম শেখ হাসিনা সরকারের দূরদর্শিতা
হাজার বছর ধরে এ অঞ্চলের মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েই বাঁচতে শিখেছে। বিষয়টি অনেকটা দেহের অবিচ্ছিন্ন অংশের মতো। মানুষের ইচ্ছা বা অনিচ্ছার সঙ্গে প্রকৃতির কোনো সম্পর্ক নেই। প্রকৃতি চলে তার নিজস্ব নিয়মে, তার উপর কারও নিয়ন্ত্রণ নেই। প্রাণিকূল তার জীবন পরিচালনায় প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। প্রকৃতি কখনো এদের কাছে আশীর্বাদ আবার কখনো অভিশাপ হয়ে আসে। বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ মহামারী আকার ধারণ করছে। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে বাংলাদেশের উচ্চতা মাত্র ১০ মিটার উপরে। ইউনেস্কোর প্রতিবেদন অনুযায়ী সামুদ্রিক উচ্চতা আর মাত্র ৪৫ সে.মি. বৃদ্ধি পেলে ম্যানগ্রোভ বলে খ্যাত সুন্দরবনের ৭৫ শতাংশ পানির নিচে তলিয়ে যাবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় জলবায়ুর পরিবর্তন জনিত কারণে নানান প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হুমকির মুখে রয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান সিকিউরিটি (ইউএনইউ-ইএইচএস) এবং ব্যান্ডনিস এন্টুইকলাং হিলফট ওয়াল্ড রিস্ক রিপোর্ট ২০১৬ প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৭১টি দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সামাজিক ঝুঁকি প্রবণতা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিশ্ব ঝুঁকি সূচকে পঞ্চম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমানে আওয়ামী লীগের সরকার দেশ পরিচালনায় রয়েছে। পরপর দুবার জনগণের রায় নিয়ে দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে জননেত্রী শেখ হাসিনা আরও বেশি আন্তরিক হয়েছেন। সরকার পরিচালনায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর সুযোগ কন্যা। জাতির জনকের কন্যা হিসাবে তার উপর জপনগণের প্রত্যাশা একটু বেশি। তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করেই তিনি যে বিষয়গুলোতে বেশি গুরুত্ব দিলেন তার মধ্যে অন্যতম হলো জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবেলার উপর। মনুষ্য সৃষ্ট বিপর্যয়ের সঙ্গে এদেশের মানুষকে সমান তালে প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোকে মোকাবেলার আত্মিক সাহস জুগিয়ে চলেছেন যিনি। তিনি শুধু আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার ভেতর নয়, প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে মোকাবেলা করার নানান কৌশল প্রয়োগ করে, আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ এখন স্বীকৃতি পাচ্ছে দুর্যোগ মোকাবেলা ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিযোজন কৌশলে উত্তরোত্তর সফলতার কারণে। ২০১৫ সালে জাতিসংঘ নীতিমালা নেতৃত্ব ক্যাটাগরিতে নেওয়া বিশেষ পদক্ষেপের কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এটি বাংলদেশের জন্য বিরল সম্মান বয়ে এনেছেন তিনি। যা পূর্বের কোনো সরকার দেখাতে পারেননি। বর্তমান সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণ নির্ভরতা কমিয়ে যথাযথ দুর্যোগ প্রস্তুতির মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা। বর্তমান সরকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় অত্যন্ত কার্যকরি ব্যবস্থা করে নজির সৃষ্টি করছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই বিষয়গুলো নিজেই দেখভাল করেন। বাৎসরিক আর্থিক বাজেটে এবারও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণসহ দুর্যোগের সময় বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এটি সরকারের আন্তরিকতার প্রমাণ বহন করে। অতীতে চোখ রাখলে আমরা দেখতে পাই ১৯৭০ সালে যে প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় দশ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সঙ্গে সঙ্গে ছুঁটে গিয়েছিলেন সেখানে। এরপর সরকার গঠন করেই তিনি প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলায় তার সরকারের বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। সেই সময় তিনি উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে মাটি ভরাট করে উঁচু স্থান নির্মাণ করে ২৩৭টি সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণ করেছিলেন পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। সেই সেন্টারগুলো মুজিব কেল্লা নাম পরিচিত ছিল। পাশাপাশি পশু সম্পদও জানমাল রক্ষা কল্পে শেড নির্মাণ করেছিলেন। নির্মাণকৃত ওইসব সাইক্লোন সেন্টারগুলো স্বাভাবিক সময়গুলোতে স্থানীয় কমিউনিটি সেন্টার, বাজার, খেলাধুলার মাঠ হিসাবে ব্যবহৃত হত। বর্তমান সরকার তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসেই প্রাকৃতিক দুর্যোগকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এর মোকাবেলায় যুগপোযোগী ও আধুনিক সরঞ্জামাদি যা প্রয়োজনের সময় ব্যাবহৃত হয় সেগুলো ক্রয় ও বণ্টন করা শুরু করেছে। আমরা বিভিন্ন সরকারিভাবে প্রকাশিত তথ্যের মাধ্যমে জানতে পারি ইতোমধ্যে আরও ১০০টি ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে এবং ২২০ টি নির্মাণ কাজ চলছে। ভবিষ্যতে আরও নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে এই সরকারের। উপকূলীয় অঞ্চলে উদ্ধার তৎপরতার জন্য ১২টি স্মল মেরিন রেস্কিউ বোট, ৪টি একুয়াটিক সার্চ ও রেস্কিউ বোট ও ১৩টি উদ্ধার মোটরযান কেনা হয়েছে। উপকূল বাসীদের যান-মালের ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনার জন্য আগাম সতর্কবার্তা প্রেরণের জন্য মেগা সাইরেনসহ স্যাটেলাইট মোবাইল ফোনের ব্যবহার বৃদ্ধি করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেড়িবাঁধ সংস্কার,পুনঃনির্মাণ কোথাও কোথাও নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। ২০০৯ সালের জুন মাস থেকে ২০১৪ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত ৬৩০ কি.মি বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও ১৫০ কি.মি বাঁধ পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে। উপকূলীয় জেলাসমূহ যেমন পটুয়াখালী, বরগুনা, সাতক্ষীরা, খুলনা, পিরোজপুর, বাগেরহাট জেলায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে জলোচ্ছাসকে মোকাবেলা করবার জন্য ১৭টি পোল্ডারকে ব্যবহার উপযোগী করা হয়েছে। এছাড়া বাঁধগুলোর উচ্চতা বৃদ্ধি ও মজবুত করতে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে তিন হাজার দুইশত আশি কোটি টাকার মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। (চলবে-০১)
লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা, জা.বি.
সম্পাদনা: আশিক রহমান