মীমাংসিত বিষয় নিয়ে আবার বিতর্ক সৃষ্টি কেন?
১৯৭১ সালে যে ৫৫ জন বাঙালি বুদ্ধিজীবী তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা স্বাভাবিক বলে বিবৃতি দিয়েছেলিন, তাদের মধ্যে সরদার ফজলুল করিমও ছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে এম আর আখতার মুকুল যে ‘চরমপত্র’ পাঠ করতেন, ঢাকা রেডিও থেকে পাকিস্তানের পক্ষে তার উত্তর দিতেন মুনীর চৌধুরী, রাজশাহী রেডিও থেকে আবু হেনা মোস্তফা কামাল। তবে ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন বা ড. হাসান জামান যত উৎসাহের সঙ্গে পাকিস্তানের পক্ষে প্রচার এবং অন্যান্য কর্মকা- চালিয়েছিলেন, অন্যেরা সেইভাবে করেননি। কারণ তারা পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন না মানসিকভাব। কিন্তু অবরুদ্ধ ঢাকাতে পিঠে বন্দুকের নল ঠেকানো থাকলে এমন অনেক কিছুই করতে হয়, যা কেউ কখনোই স্বজ্ঞানে করবে না। এসব ভেবেই স্বাধীনতার পরে ড. নীলিমা ইব্রাহীমকে প্রধান করে বঙ্গবন্ধু একটি কমিশন গঠন করে দিয়েছিলেন যার কাজ ছিল কারা কারা পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়েছেন, আর কারা কারা সত্যি সত্যিই পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছেন তা খুজে বের করা। সেই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল বলে জানি। তাহলে এখন এত বছর পরে খান আতার প্রসঙ্গ নিয়ে এটি আবার সামনে চলে আসছে কেন?
তারা কেন নিজেদের মৃত্যু বেছে নিলেন না, এটাই কি তাদের অপরাধ?
এইভাবে যারা দোষারোপ করতে চান, তাদের উদ্দীপনাকে শ্রদ্ধা না করে পারা যায় না। কিন্তু এটুকু বোঝা যায়, ওই পরিস্থিতিতে থাকলে বাস্তবে তারা কী করতেন। কীভাবে বুঝলাম আমি? খুব সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ধর্ম নিরপেক্ষতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার হেফাজতের দাবি মেনে নিয়ে পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ করল। সেই সময় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দাবিদার কোনো বুদ্ধিজীবী বুক চিতিয়ে প্রতিবাদ করেছেন? আনিসুজ্জামান? নির্মলেন্দু গুণ? সেলিনা হোসেন? মুহাম্মদ জাফর ইকবাল? সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে কে দাঁড়িয়েছেন সেই অপকর্মের বিরুদ্ধে? হাসান ইমাম? নাসিরউদ্দীন ইউসুফ? গোলাম কুদ্দুস?
সাংস্কৃতিক জোটের সদস্যদের মধ্যে প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করল কেবলমাত্র ‘উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী’। আর মিছিল-মিটিং-শ্লোগান দিল বাম ঘরানার কিছু ছেলেমেয়ে। সমর্থন দিলেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, হাসান আজিজুল হক, যতীন সরকার। অন্যসব বিখ্যাত ব্যক্তিরা যে প্রতিবাদের সাড়িতে দাঁড়ালেন না তার কারণ কী? নিশ্চয়ই সরকারের রোষানলে পড়ার ভয়! অথবা প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়! ভাবা যায়? যে বাচ্চু ভাই প্রাণবাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, তিনি পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম স্তম্ভ ধর্মনিরপেক্ষতার এমন পরিণতি দেখেও টুঁঁ শব্দটি করলেন না!
যদি বারবার আপনারা একাত্তরেই ফিরতে চান, যদি বারবার এই কথাটাই বলতে চান যে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়নি, তাহলে এখন, এই সময়ে, একাত্তরে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করা অনেককেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত হতে দেখেও নিশ্চুপ থাকার দায়ে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। দাঁড়াতেই হবে!
লেখক: কথাসাহিত্যিক/ফেসবুক থেকে