মিয়ানমার সেনাবাহিনী কি এক ঢিলে দুই পাখি মারছে!
রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন ও সহিংসতার ঘটনা নতুন নয়। তবে অং সান সুচির ক্ষমতাগ্রহণের পর এবারই রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা ও বর্বরতার মাত্রা ও সময় দীর্ঘ। উল্লেখ্য ইতোপূর্বে বাংলাদেশে দুই লাখের বেশী শরনার্থী ছিলোই এর সঙ্গে গত দুই মাসে প্রায় ৫ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে এবং বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে আরও এক লাখ দেশ ছাড়ার পথে রয়েছে ( ইউএন)।
১৯৭৮ সালে ‘অপারেশন কিং ড্রাগন’ নামে অভিযান চালানো হয় রোহিঙ্গা বিদ্রোহিদের ওপর, সেসময় তারা মিয়ানমার সরকারের কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। আবার নব্বই দশকের পরবর্তী সময়ে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশন (আরএসও) নামে সংগঠনকে মোকাবিলা করতে মিয়ানমার সেনা ‘অপারেশন ক্লিন এন্ড বিউটিফুল নেশন’ নামে অভিযান চালায়। এর পরবর্তী সময়েও আরও কিছু ছোট অভিযান চলে রোহিঙ্গা বিদ্রোহিদের ওপর। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে আবার মিয়ানমার সেনা ও রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের সংঘর্ষে সাধারণ জনগণসহ প্রায় ১৩৪ জন মারা যায়। আগস্ট ২০১৭ সালে জঘন্যতম অগ্নিসংযোগ, হত্যা, নির্যাতনে নারী শিশুসহ এ সংখ্যা ৩ হাজারেরও বেশী, যা চলমান।
রোহিঙ্গা সাধারণ জনগোষ্ঠির ওপর সহিংসতার মাত্রা এবারই বেশি। এর আগে যতবার রোহিঙ্গাদের ওপর সেনা অভিযান চলেছে তখন সুচি ছিলেন ক্ষমতাহীন বিরোধীদলে ও গৃহবন্দী। কিন্তু এবার মিয়ানমার সেনাদের সহিংসতার ব্যাপারে ক্ষমতাসীন সুচির নিরবতা বিশ্বনেতাদের দুঃচিন্তার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনী বিশ্বনেতাদের অনুরোধ, হুমকি উপেক্ষা করে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির উপর বর্বরতা চালিয়ে যাওয়ার পেছনে উদ্দেশ্য কি কেবলই বাঙালী মুসলিম জঙ্গিগোষ্ঠিকে রাখাইন থেকে বিতারিত করা, নাকি আরও কিছু। সুচি কি বুঝতে পারছে না সেনাবাহিনী তার সম্ভাবনা ও অর্জনগুলোকে মুছে দিতেই পরিকল্পিতভাবে এই রোহিঙ্গা নিধন চালিয়ে যাচ্ছে। সুচির বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপি যত নিন্দা ও সমালোচনা হচ্ছে, মিয়ানমার সেনাদের সহিংসতা যেন তত বাড়ছে। এমনও আশংকা করা হচ্ছে যে, সেনাবাহিনী যে কোন সময় সামরিক শাসন জারী করতে পারে।
নেতৃস্থানীয় দেশগুলোর সকল ক্ষোভ এবং বিরক্তি সুচির ওপর। সেনাদের প্রতি তার নিরব সমর্থন মেনে নিতে পারছেন না তারা। দুই যুগের বেশি সময় ধরে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই এর কারণে গণতন্ত্রকামী নেত্রী হিসাবে যে সম্মান ও সমর্থন বিশ্ববাসী তাকে দিয়েছিলো, গত কয়েকদিনে তার বেশিরভাগ নষ্ট হয়ে গেছে।
১৯৯১ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেবার সময় তৎকালিন নোবেল কমিটি প্রধান তাকে ধহ ড়ঁঃংঃধহফরহম বীধসঢ়ষব ড়ভ ঃযব ঢ়ড়বিৎ ড়ভ ঃযব ঢ়ড়বিৎষবংং’ অভিধা দিয়েছিলো, সেই নোবেল কমিটিই তার এই সম্মান ফিরিয়ে নেয়ার কথা ভাবছেন। অক্সফোর্ড কলেজ কাউন্সিল তাদের কমন রূম থেকে সুচির নাম সরিয়ে ফেলেছে, এর আগে তারা অক্সফোর্ড কলেজ থেকেও তার ছবি সরিয়ে দিয়েছে। মিয়ানমার সেনাদের সহিংসতার ব্যপারে তার নিস্ক্রীয়তাকে অমার্জনীয় বলে মনে করছেন তারা। গ্রামীন ব্যাংক প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনুস রোহিঙ্গা সমস্যার জন্য এককভাবে সুচিকেই দায়ী করেছেন। নিউ ইয়র্ক টাইমস সম্প্রতি তাদের এক প্রতিবেদনে লিখেছে, “গুধহসধৎ, ড়হপব ধ যড়ঢ়ব ভড়ৎ ফবসড়পৎধপু, রং হড়ি ধ ংঃঁফু রহ যড়ি রঃ ভধরষং”. এছাড়া ইউএন, ইইউ যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য বিশ্ব নেতারা ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রদানের চিন্তাভাবনা করছেন।
গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে ১৫ বছর গৃহবন্দী থেকে যে অবিসংবাদিত নেতার উদাহরন তৈরী করেছিলেন তিনি। তবে কখনই সুচি রোহিঙ্গাদের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন না। ২০১৫ সালের নভেম্বরে ২৫ বছরে প্রথম অংশগ্রহনমূলক নির্বাচনে ‘ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)’র প্রধান হিসেবে নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেন অং সান সুচি। যদিও সাংবিধানিক কারণে তিনি রাষ্ট্রপতি হতে পারেননি, তিনি ডি ফ্যাকটো লিডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সূত্র: বিবিবি নিউজ, নিউইয়র্ক টাইমস এবং উইকিপিডিয়া
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি