পুলিশের ভাবমূর্তি সমুজ্জ্বল রাখার দায়িত্ব কার?
পুলিশের কাজের স্বাধীনতা, সীমাবদ্ধতা নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন উঠলেও এটা কখনো জোরালো হয় না। পুলিশকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দেওয়ায় রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘বডি’তে যে ‘পোকা’ ধরেছে এর বহুপ্রমাণ চোখের সামনে। কিন্তু আমরা সাবধান হচ্ছি না, আমরা দুর্বলতার ‘ফাঁক-ফোকর’ দিয়ে বেরুবার চেষ্টা করছি। সত্য স্বীকার করতে চাইছি না। প্রায় প্রতিটি ঘটনাই যেনো পুকুরে ঢিল ছোঁড়ার মতো, একসময় মিলিয়ে যায়। কিন্তু যে কথাটি সহজে মিইয়ে যায় না তাহলোÑ পুলিশ কী না পারে? এটি বহু যুগ আগ থেকেই শুনে আসছি। এদেশে সর্বাধিক প্রচারিত। যদিও এর পেছনে অসংখ্য প্রশ্ন রয়েছে। যেসব প্রশ্নের জবাব জানি এরপরও আমরা মুখ কুলুপ দিয়ে থাকি। এটা আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক চরিত্র। আমরা অপরকে দায় দিতে জানি, নিতে জানি না। এ লেখাটির সূত্রপাত মূলত সাম্প্রতিককালে দুটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। পুলিশ প্রসঙ্গে সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়া দুটি ঘটনা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়ে জনমনে। গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তার নৈতিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অপর ঘটনার সদস্যরা কর্মকা- অরো জঘন্য। তারা মাঠ পর্যায়ের। অথচ এই শ্রেণিটার ওপরই নির্ভর করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। কিন্তু রক্ষক যদি ভক্ষক হয়ে ওঠে তাহলে এই ব্যধি দূর হবে কীভাবে? ভয়টা এখানেই। সম্প্রতি দুর্নীতির মাধ্যমে ৮ কোটি ৩৬ লাখ টাকা উপার্জনের অভিযোগে ফরিদপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) সুভাষ চন্দ্র সাহা ও তার স্ত্রী রীনা চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
অপর ঘটনাটি মাঠপর্যায়ের। টেকনাফে মুক্তিপণের ১৭ লাখ টাকাসহ আটক পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সাত সদস্যকে বরখাস্ত করা হয়েছে। টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সড়কের মহেষখালীয়াপাড়া এলাকায় সম্প্রতি তারা আটক হন। বরখাস্তদের মধ্যে দু’জন এসআই, তিনজন এএসআই ও দু’জন কনস্টেবল রয়েছেন।
অতিরিক্ত আইজিপি (প্রশাসন) মোখলেসুর রহমানের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, কোনো পুলিশ সদস্য অপরাধ করলে তার দায়ভার তাকেই নিতে হবে। বাহিনী তার অপরাধের দায়ভার নেবে না। আইনের চোখে সবাই সমান। পুলিশ ও জনতার মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। অপরাধ করলে অবশ্যই শাস্তি হবে। পুলিশ সদস্য হিসেবে ছাড় দেয়া হবে না। কিন্তু যদি আমরা এ প্রশ্নটি করি যে, তারা এমন সাহস পেলো কীভাবে? এর পেছনে তো অসংখ্য প্রশ্ন রয়েছে, যেসব প্রশ্নের জবাব নেই। আমরা দেখছি, রাষ্ট্রের পুলিশকে যেনো কেউ কেউ ব্যক্তিগত কর্মচারির মতো ব্যবহার করছেন। আর এর সুযোগ নিচ্ছে সমাজের বা রাষ্ট্রের অপশক্তি। অথচ পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্য জীবন বাজি রেখে সন্ত্রাসী ধরেছে ও ধরছে, জামায়াত-শিবিরের অপকর্মের ফাঁদ আবিষ্কার করেছেন, জঙ্গিদমনের অভিযানে জীবন দিয়েছেন কেউ কেউ। অথচ নেতিবাচক কিছু ঘটনায় আমরা এতোটা অবাক হই যে, পুলিশকে নিয়ে গর্ব করবার এই সুযোগটার ছেদ পড়ে। অনেকে বিশ্বাস করেন পুলিশে নিয়োগের সময় মোটা অংকের অর্থ লেনদেন হওয়ার অভিযোগ। যার প্রভাব পড়ছে পুলিশ সদস্যদের ওপর। ফলে এক শ্রেণির পুলিশ হয়ে পড়ছে দুর্নীতিবাজ। চাকরিতে নিয়োগের সময় দেওয়া ঘুষের টাকা তুলতে গিয়ে কিছুসংখ্যক সদস্য বিভিন্ন ধরনের খারাপ পথ বেছে নেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে সিনিয়র অফিসারদের চাপে পড়েও অপরাধে জড়াচ্ছে পুলিশ সদস্যরা। তাই শুধু দ- দিয়ে পুলিশের অপরাধ প্রবণতা কমানো যাবে না। সম্প্রতি কমিউনিটি পুলিশিং বিষয়ে একটি আলোচনায় অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়েছিলো।
সেখানে খুব সুন্দর সুন্দর কথা আলোচিত হয়, সরকারের রথি-মহারথিরা ছিলেন। কিন্তু ওইসব সুন্দর কথা, মাঠ পর্যায়ের পুলিশের অসহায়ত্ব নিয়ে সমস্যা, পুলশের ভেতরের সঙ্কট কোনোদিনই আলোচনায় স্থান পায় না। একজন অতিরিক্ত আইজিপি গর্ব করে জানালেন, আমরা পুলিশকে ছাড় দেই না। তার দেয়া পুলিশ সদর দফতরের সর্বশেষ তথ্য মতে, ২০১১ সাল থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত নানা অপরাধে জড়িত থাকার অপরাধে ৭৭ হাজার ৯২৬ জন পুলিশ সদস্যকে অর্থদ-, বাধ্যতামূলক অবসর ও চাকরিচ্যুত, তিরস্কার, বদলি বরখাস্ত করা হয়েছে। দ-প্তদের মধ্যে ৭৬ হাজার ৯৯ জনই কনস্টেবল থেকে উপপরিদর্শক (এসআই) পদের। বাকিরা পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর), সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) ও তদূর্ধ্ব পদের কর্মকর্তা। কিন্তু এই ব্যবস্থা নেওয়াই কী শেষ কথা? পুলিশকে আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিচ্ছি নাÑ একথাটি ক্ষমতাধররা বলে থাকেন, যারা থানার ওসি কিংবা এসি অথবা মাঠ পর্যায়ে কর্মরত গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা-কর্মচারিকে ‘ফরমায়েশি’ চার্জশীট, বা ‘ফরমায়েশি’ মামলা নিতে অনুরোধ করেন। কথা না শুনলে চাপ সৃষ্টি করে থাকেন, কথায় কথায় পুলিশের আইজি, ডিআইজির ভয় দেখান, এমনকি চাকরি খাওয়ার হুমকিও দিয়ে থাকেন সেইসব ক্ষমতাধররা। এই যে, ডবল স্ট্যান্ডার্টের রাজনীতি, আমাদের শাসন ব্যবস্থা বা সমাজ ব্যবস্থাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে! এখনো সময় আছেÑ ভালো কাজের প্রশংসার পাশাপাশি অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবেÑ যাতে প্রকৃত অপরাধী কোনো ফাঁক-ফোকরে রেহাই পেতে না পারে?
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গল্পকার
সম্পাদনা : আশিক রহমান ও মোহাম্মদ আবদুল অদুদ