বুদ্ধিজীবী হত্যার সাক্ষী বটগাছ এখন অবৈধ দখলে
রবিউল আলম
স্বাধীনতা সংগ্রামে উল্লেখযোগ্য ঘটনা শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৪ ডিসেম্বর এলে আমরা দিবসটি পালনে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করি, সবকয়টি চ্যানেলে স্মৃতিচারণসহ নানা ধরনের আলোচনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু ১৪ ডিসেম্বরের প্রকৃত ইতিহাস কতজন মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ আমরা জানি। বা কতজন মানুষ আমরা রায়ের বাজার বদ্ধভূমির শহীদ বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকা- কাছ থেকে দেখেছি এবং রায়ের বাজার বদ্ধভূমি থেকে জীবিত ফেরৎ আসতে পেরেছি। যারা জীবিত আছে, তাদের কাছ থেকে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন কিছু শুনতে চেয়েছে বলে আমার জানা নেই।
আমার চোখে দেখা ১৪ ডিসেম্বরের ঘটনাবলী বাংলার বাণী ও দৈনিক আমাদের অর্থনীতি পত্রিকার মাধ্যমে প্রকাশ করতে পেরেছি এবং এখনো করছি। ইলেকট্রিক মিডিয়া ৭১ জার্নাল ও এটিএন নিউজ-এ একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ের ইতিহাসের স্বাক্ষী রায়ের বাজারের বট গাছটি এখনো অবৈধ দখলদারদের অধীনে। প্রশাসন এই বট গাছটি উদ্ধার করে জাতির সামনে তুলে ধরার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নাই। ১৯৭১ সালে আলবদর, আল শামস, রাজাকার ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার জন্য ক্যাম্প থেকে নিয়ে আসতে এই বট গাছের পথ বেছে নিয়েছিল। রাতের আধারে দল বেধে একাধিক বুদ্ধিজীবীকে টেনে- হেচড়ে বর্তমান বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে নেওয়ার পথে বট গাছের নীচে চলতো শারীরিক নির্যাতন, অনেক বুদ্ধিজীবীর জীবনাবসান হয়েছে এই রায়ের বাজার বট গাছের নীচে। বট গাছটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে সংকুচিত হয়ে অবৈধ দখলদারদের অধীনে। আমার ভাবতে অবাক লাগে, ইতিহাসের স্বাক্ষী এই বট গাছটি কিভাবে অবৈধ দখলদারদের অধীনে থাকতে পারে। আমাদের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানরা যখন ১৪ ডিসেম্বর রায়ের বাজার বদ্ধভূমিতে পিতাদের স্মরণ করতে আসেন, তারা কি জানতে পারেন তাদের পিতাদের হত্যার আগে কিভাবে কোথায় নির্যাতন করা হয়েছিল, আসলে জানার ইচ্ছা সবারই আছে, আমরা কি তাদেরকে জানতে দিচ্ছি? পুলপারের বৃহৎ এই বট গাছটি সরকারের সম্পত্তি, বট গাছের নীচ দিয়ে একটি বৃহৎ রাস্তা ছিল, এই রাস্তা দিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের লাশ ও জীবিতদের বদ্ধভূমিতে নিয়ে যাওয়া হতো। ৮ ডিসেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বর প্রতি রাতে বুদ্ধিজীবীদের আত্মচিৎকারে গগণবিদারী কান্নার সুর বাজত। আমার বাড়ি রায়ের বাজার বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের পাশে থাকায় অনেক কিছু দেখার ও শোনার দূর্ভাগ্য হয়েছে। ১১ ডিসেম্বর মাছ ধরতে গিয়ে বুদ্ধিজীবীদের পরে থাকা লাশগুলো স্বচক্ষে দেখতে পাই, হানাদার বাহিনীর কাছে গ্রেফতার হই, মুক্তি পাওয়ার ইতিহাস নিয়ে অনেক লিখেছি। পরে বুদ্ধিজীবীদের লাশ নিজ হাতে তুলে দিয়েছিলাম। প্রখ্যাত সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা নির্মল সেন অনেক দিন রায়ের বাজারে আমাদের বাসায় থেকেছেন, সেই অজানা ইতিহাস আগেও লিখেছি এবং পরে আরেকদিন লিখব। আজ শুধু বট গাছ-এ থাকতে চাই। একদিকে রায়ের বাজার, ফিজিক্যাল কলেজ, আলবদর বাহিনীর হেড কোয়ার্টার, অন্যদিকে কাটাসুর আব্দুল হাই কোম্পানির বাড়ি রাজাকার ক্যাম্প, পশ্চিমে রায়ের বাজার বধ্যভূমি। এখন রায়ের বাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, মাঝপথে বট গাছ। গতবার ১৪ ডিসেম্বর এটিএন নিউজ ৩টি পর্বে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। আশা করেছিলাম ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের দৃষ্টিতে আনবেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। সব পরিচয় লেখা সম্ভব নয় শুধু ৭১ -এর জার্নাল থেকে বের হওয়ার পথে শহীদুল্লাহ কায়সারের মেয়ে শমী কায়সার বলেছিলেন, আপনার হাতে কি আমার বাবার লাশের গন্ধ আছে।
হয়তো আছে হয়তো নাই, শত শহীদের লাশের সাথে কি ছিল শহীদুল্লাহ কায়সারের লাশ, আমি সে কথার উত্তর দিতে পারি নাই। ডা. আলীম চৌধুরীর লাশ রায়ের বাজার স্মৃতিসৌধে পাওয়া গেছে। শমী কায়সারের কথাটি আমার কাছে অমর বাণী হয়ে থাকবে, এই একটি কথা আমার জীবনের পুরস্কার মনে করছি। অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন উপস্থাপিকা মিথিলার সামনে কাঁদতে পারি নাই। সরকারের স্বীকৃতি না পেলেও শমী কায়সারের স্বীকৃতি রায়ের বাজার বদ্ধভূমি নিয়ে লেখার উৎসাহ যুগিয়েছে নাঈমুল ইসলাম খানের মতো সম্পাদক আছেন বলে। আশা করব, আগামী ১৪ ডিসেম্বর আসার আগে বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতি বহনকারী বট গাছটি উদ্ধার করে শহীদদের সন্তানদের কাছে উপহার দেওয়া হবে।
১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস পালন করি, হত্যার প্রকৃত ঘটনাগুলো আড়াল করছি এক টুকরো জমির জন্য। মুক্ত করুন শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নির্যাতনের স্থান, নতুন প্রজন্মকে জানতে দিন, দেখতে দিন, আগামী ১৪ ডিসেম্বর আসার আগেই মুক্ত হউক ঐতিহাসিক সেই বট গাছ।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতি
সম্পাদনা : আশিক রহমান ও মোহাম্মদ আবদুল অদুদ