উৎপলকে খুঁজে পাওয়াটা জরুরি
প্রতীক ইজাজ
ওকে আমাদের খুঁজে পাওয়াটা জরুরি। ও আমাদের সহকর্মী। নাগরিক। চলতে চলতে একদিন হঠাৎ একজন মানুষ উধাও হয়ে যাবে, আমরা তার কোনো খোঁজ পাব না, এটা কী হয়! হয় না। উদ্বেগ উৎকন্ঠা ছাপিয়ে এই নিখোঁজ অনিশ্চয়তা বাড়ায় ব্যক্তি-সামগ্রিক নিরাপত্তায়। কাজে শ্রমে গানে আমাদের অমনোযোগী করে তোলে। দুশ্চিন্তা বাড়ে সংসার, যাপিত জীবনে। এভাবে সময় টানা যায় না। ভারী ভারী লাগে। আমি উৎপলের কথা বলছিলাম। উৎপল দাস। অনলাইন পোর্টাল পূর্বপশ্চিমের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক। ১০ অক্টোবর থেকে ওর কোনো খোঁজ নেই। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় গেল ছেলেটা, কী হলো, কেমন আছেÑ কিছুই জানতে পারছি না আমরা। ওর প্রতিষ্ঠান থানায় জিডি করেছে। পুলিশ বলছে, সন্ধান চলছে। অসহায় পরিবার সংবাদ সম্মেলন করে ছেলেকে উদ্ধারের আকুতি জানিয়েছে। কী হতে পারে উৎপলেরÑ এ নিয়ে নানা আলোচনা চারপাশে, গণমাধ্যম কর্মীদের মধ্যে। পত্রিকাগুলোয় সংবাদ ছাপা হচ্ছে। নানা মন্তব্য আসছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ব্যক্তি দৃষ্টিকোণ থেকে চলছে আলোচনা, সমালোচনা। তাতে কেবল উৎকন্ঠাই বাড়ছে। উৎপল ফিরে আসছে না।
উৎপল নিখোঁজ। কিন্তু কেন? এ প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক। মুক্তিপণ আদায়, নাকি নেপথ্যে অন্য কোনো কারণ রয়েছেÑ এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে গণমাধ্যমে। বেশ কিছু ভাবনা আমার মধ্যেও। এক হতে পারেÑ ওর কোনো ব্যক্তিগত শত্রু থাকতে পারে, বা কারও সঙ্গে আর্থিক লেনদেন বা অন্যকোনো বিষয়ে কোনো ঝামেলা থাকতে পারে। জীবনের প্রতি ঘামখেয়ালিপনা, বাউলিয়ানার কথাও বলছেন অনেকে। মুক্তিপণের বিষয়টিও আলোচনায় আসছে। কিন্তু তাই বলে এতদিন! যুক্তিতে কুলোয় না। উৎপল সাংবাদিক। ভাবি, তবে কি কোনো নিউজের কারণে কোনোপক্ষের বিরাগভাজন হলো? ওই পক্ষের অসন্তুষ্টই কি ওর নিখোঁজের পেছনের কারণ? ছেলেটা ভুল ব্যক্তি ভাবনা থেকে, বুঝতে না পেরে, কিংবা ইচ্ছে করেই ব্যক্তি আক্রোশে এমন কোনো নিউজ করল যা ওর করাটা উচিত হয়নি। বা উৎপল ঠিকই লিখেছিল?
জানি না। তবে কি জন্য নিখোঁজ হলো- সেই সত্য জানতেই উৎপলকে আমাদের পেতে হবে। পাওয়াটা জরুরি। ও কী এমন ভুল করল, যার খেসারত দিতে হচ্ছে ওকে, ওর পরিবারকে, আমাদের? সেই কারণ জানতে পারলে আমরাও শোধরাতে পারতাম নিজেদের। সাবধান হতাম। ভবিষ্যত নিখোঁজ যাত্রায় সতর্ক করতে পারতাম স্বজন, সহকর্মীদের।
উৎপল যদি কোনো ভুল বা অপরাধ করে থাকে, তার জন্য ওকে শাস্তি পেতেই হবে। পাওয়া উচিত। তবে সে শাস্তি হতে হবে প্রচলিত আইনে, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে। কখনোই কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারেন না। উচিত নয়। সেটা হলে রাষ্ট্রের নানা অনুষঙ্গের শৃঙ্খলা বিঘিœত হয়। অপরাধ বাড়ে। সরকার ও রাষ্ট্রের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যায়। সর্বজনীন রাষ্ট্রভাবনা ও নাগরিক স্বাধীনতা ক্ষুণœ হয়। উৎকন্ঠা উদ্বেগ বাড়ে। নাগরিকরা নিজেদের ভীষণ অসহায় মনে করে। এমনিতেই টানাপড়েনের সংসার আমাদের। নাগরিক হিসেবে এখনো কোনো সুরক্ষা নেই। রাতে বাড়ি ফিরতে হয় একা, গণপরিবহনে। রাতবিরেতে অন্ধকার গলিতে ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে প্রায়ই খোয়াতে হয় সর্বস্ব। নিউজে ইচ্ছে না অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। পেশাগত কারণে বন্ধু-স্বজনরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ব্যক্তিগত শত্রুর জন্ম নেয়। একধরণের ভয় নিয়ে চলতে হয় রাস্তাঘাটে। রাতে বাড়ি ফেরার সময় সংসার সন্তান স্বজনদের কথা ভাবতে হয়। পয়সায় কুলোয় না। মাস শেষে ঋণ বাড়ে। ন্যূননতম যে মুদির দোকান, বাকি ফাঁকি দিতে এড়িয়ে চলতে হয় দোকানের মালিককেও। বেতন দেরি হয়ে যায়। মিথ্যে বলতে বলতে অবিশ্বাস দূরত্ব বাড়ে বাড়ির মালিকের সঙ্গে। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের অসঙ্গতি লেগেই থাকে। স্বপ্নের সঙ্গে সাধের বনিবনা হয় না কখনোই। তবুও কষ্ট নেই। অনুতাপ আছে। আনন্দ পাই। সৎ পথে চলার, সত্য বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার জন্য লড়ে যাই প্রতিনিয়ত। তর্কে-বিতর্কে সময় কাটে। সময় ফুরায়। স্বপ্ন ভাঙে। স্বপ্ন গড়ি। পথ চলি। খোলা মন, সবুজ প্রান্তর, নীল আকাশ। যুক্ত হয় টুকরো টুকরো ভাল লাগা, আনন্দযোগ। ভাবি, এই তো আর কয়েকটা দিন। তারপরই তো শেষ। এ কয়েকটা দিন কাটুক না সময় সুন্দর সাম্যের পথে। সবাইকে নিয়ে। এরই মধ্যে যদি উৎপল হারিয়ে যায়, মনকে বোঝাতে পারি না। মাথার মধ্যে হাজার জোনাক পোকা কিলবিল করে উদ্বেগ, উৎকন্ঠা হয়ে। এত মানুষ আমরা, এত সুন্দর স্বাধীন রাষ্ট্র, এত নিরাপত্তাবলয় চারপাশে, সেখানে কেউ হারাতে পারে না। পারাটা উচিত নয়। উৎপলকে ফিরতে হবে। সত্যটা জানতে হবে। তবেই না তৈরি হবে সুসংশোধিত ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র। সবাইকে নিয়েই তো আমরা। একা নই। বিচ্ছিন্ন নই। চলতে হবে সম্মিলিতভাবে, শুভশক্তির সংযোগে। এসব টুকরো টুকরো আনন্দ, অনটন, ঝঞ্ঝা আছে বলেই আমরা এখনো এক, যৌথ, যুথবদ্ধ। এ সত্যই আমাদের শক্তি।
লেখক: সাংবাদিক, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী
সম্পাদনা : আশিক রহমান