খালেদ মোশাররফ : এক বিস্মৃত বীর
খালেদ মোশাররফ। একজন অসীম সাহসী বীর যোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর- ২ এর অধিনায়ক হিসেবে সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। শুধু তাই নয় ঢাকার গেরিলা যোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছেন মুক্তির মন্ত্রে। সীমান্তের ওপাড়ে হাজার হাজার তরুণ যুবককে দিয়েছেন প্রশিক্ষণ। তার কাছ থেকেই গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন রুমি, বদি, আজাদ, জুয়েলসহ হাজার হাজার অকুতোভয় তরুণ যোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঢাকাবাসীর কাছে খালেদ মোশাররফ ছিলেন কিংবদন্তীতুল্য এক চরিত্র। এক পর্যায়ে তার মৃত্যু নিয়ে ভুল সংবাদ প্রচারিত হলে ঢাকাবসীর মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তার একাত্তরের দিনগুলি বইয়ে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। ১৯৭১ সালে খালেদ মোশাররফ পদাতিক ব্রিগেড হেডকোয়ার্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ ব্রিগেড মেজরের দায়িত্বে ছিলেন। ২৫ মার্চের নীল নকশা অনুযায়ী মাত্র কয়েক ঘণ্টার নোটিশে তাকে কুমিল্লায় বদলি করা হয়। সেখানে তিনি যোগ দেন ২২ মার্চ। ২৪ মার্চ একটা কোম্পানি নিয়ে তাকে শমসেরনগরে রওনা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ঐ এলকার সীমান্ত দিয়ে নকশালরা বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে আর তাদের দমনের কল্পিত মিশনে তাকে পরিকল্পনামাফিক ঐ এলাকায় পাঠায় পাক সেনা কর্মকর্তারা। খালেদ মোশাররফ তার কোম্পানি নিয়ে ব্রহ্মণবাড়িয়া হয়ে শমসেরনগর রওনা হন। রাতে তিনি ব্রহ্মণবাড়িয়া অবস্থান করেন। এ সময় প্রচুর ব্যারিকেডে রাস্তাঘাট প্রায় বন্ধ ছিল। স্থানীয় জনতার বাধার মুখে তার কোম্পানী সামনে এগুতে পারছিল না। সে সময় তার সাহায্যে এগিয়ে আসেন আগে থেকেই ব্রহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থান নেওয়া শাফায়েত জামিল। তাকেও কল্পিত শত্রু দমনে সেখানে পাঠনো হয়েছিল। এ সময় খালেদ উত্তেজিত জনতাকে বলেন বেঙ্গল রেজিমেন্ট বাংলাদেশের রেজিমেন্ট। প্রয়োজনের সময় এই রেজিমেন্ট পিছিয়ে থাকবে না। ২৫ মার্চের পর পরিস্থিতি পুরোপুরি পাল্টে যায়। হাজার হাজার মানুষ ঢাকা ছাড়তে থাকেন। সারা দেশের মতোই চমর উত্তেজনা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট ও ব্রহ্মণবাড়িয়ায়। ২৭ মার্চেই ব্রহ্মণবাড়িয়ায় বিদ্রোহ করেন শাফায়েত জামিল। বিকালের এক মিটিং এ পুরো কমান্ডের দায়িত্ব দেন খালেদ। সবার ধারণা ছিল খালেদ মোশাররফ তাদের সাথে নিয়ে কুমিল্লা আক্রমণ করবেন। কিন্তু যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী খালেদ সে পথে পা বাড়ান নি। কারণ, তিনি জানতেন এমন পদক্ষেপ হবে চরম আত্মঘাতি। আবেগের বশে শুধু প্রাণহানিই ঘটবে। কর্নেল শাফায়েত জামিল তার ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর’ বইতে লিখেছেন ‘সেদিন খালেদ মোশররফের উইথড্রয়াল ও কনসলিডেশন সিদ্ধান্তে অনেকেই মনঃক্ষুণœ হয়েছিলেন। তবে বাস্তবতা অনুযায়ী তার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল।’
পাক সেনাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নেওয়া খালেদের জন্য অনেক বড় সিদ্ধান্ত ছিল। কারণ তার স্ত্রী রুবী ও দুই মেয়ে তখনো ঢাকায়। ২৫ মার্চের পরপরই পাক সেনারা তার শ্বশুড় বাড়িতে হানা দেয়। তার স্ত্রী ও দুই মেয়েকে না পেয়ে ধরে নিয়ে যায় বড় শালী, শ্বশুড়-শাশুড়ি ও ভাইরা-ভাইকে। প্রথম কয়েকদিন খালেদের স্ত্রী তার দুই সন্তানকে নিয়ে গ্রেফতার এড়াতে বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনদের বাসায় লুকিয়ে থেকেছে। এপ্রিলের মাঝামাঝিতে রুবী নানা ঝুঁকি মাথায় নিয়ে খালেদের কাছে পৌঁছায়। কিন্তু সেবার মেয়েদের ঢাকা থেকে বের করে আনা সম্ভব হয়নি। এর কিছুদিন পর সামরিক কর্তৃপক্ষ খালেদের মেয়েদের সন্ধান পায়। সেনাবাহিনীর অধীনে তাদের রাখা হয় অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয়ের হেড মিসস্ট্রেস আনোয়ারা মনসুরের বাসায়। এর কিছুদিন পর খালেদের গেরিলা বদি, চুল্লু, স্বপন, কাজী ও বাদল দুই মেয়েকে উদ্ধারে এক দুর্ষর্ধ অভিযান চালায়। ঐ হেড মিসস্ট্রেসের বাসা থেকে খালেদের বড় মেয়ে বেবিকে তুলে আনতে সক্ষম হন গেরিলারা। কিন্তু ছোট মেয়েকে নিয়ে আসতে পারেনি তারা।
যুদ্ধ শুরুর কয়েক মাস মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত ছিলেন না। অনেকর মধ্যেই যুদ্ধে যোগ দেওয়া নিয়ে দ্বিধা ছিল। তবে সময় গড়ানোর সাথে সাথে সেই দ্বিধা কেটে যায়। মুক্তিযুদ্ধকে একটি পরিকল্পিত সংগ্রামে রূপদানের উদ্দেশ্যে সেনা কর্মকর্তাদের প্রথম বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়া চা বাগানে। এই বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত হলেও মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় যুদ্ধ শুরুর সাড়ে তিন মাস পর ১১ জুলাই। মেজর খালেদ মোশাররফকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ২ নাম্বার সেক্টরের। এই সেক্টরটি ফরিদপুরের একাংশ, কুমিল্লা ও রাজধানী ঢাকা নিয়ে গঠিত ছিল। তিনি সহযোদ্ধা হিসেবে বেশ কয়েকজন অসীম সাহসী যোদ্ধাকে পেয়েছিলেন। যাদের মধ্যে সালেক চৌধুরী, খোন্দকার আজিজুল ইসলাম, সিতারা বেগম, মমতাজ হাসান, এম এ মতিন আইনউদ্দীন, গাফফার হাওলাদার, এটিএম হায়দার, মেহবুব রহমান, হারুন অর রশিদ, ইমামুল জামান ও আকবর হোসেনসহ অনেকেই। মুক্তিযুদ্ধে গৌরবজনক অবদান রাখার জন্য বেসামরিক গেরিলাদের মধ্যে ৩৭ জনকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাব দেওয়া হয়েছিল। যাদের মধ্যে এই ২ নাম্বার সেক্টরের যোদ্ধা ছিলেন ১২ জন।
২ নাম্বার সেক্টরের যুদ্ধ পরিচালনা করতে গিয়ে খালেদ মোশাররফকে অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। তাকে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়তে হয় মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুট নিয়ে। ঢাকা থেকে প্রচুর মুক্তিপাগল ছেলে সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছিল। যারা যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল। কিন্তু কিছু জটিলতায় খালেদ তাদের প্রশিক্ষণ দিতে পারছিলেন না। মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট করার সময় দলীয় বিবেচনার একটি বিষয় ছিল। বামপন্থী বা অন্যান্য দলের ছেলেদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও রিক্রুট করার বিষয়ে কিছু নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু খালেদ মুক্তিপাগল এই তরুণদের কাজে লাগাতে চাচ্ছিলেন। অনেক সময় মুজিবনগর সরকারের সিদ্ধান্তকে পাশ কাটিয়ে তিনি অনেক তরুণকে প্রশিক্ষণ দেন। সময় গাড়ানোর সাথে সাথে তার ক্যাম্পে এতো ছেলে এসে জমা হয় যে তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে খালেদকে হিমশিম খেতে হয়। তারপরও বিচ্ছু বাহিনী, ক্র্যাক প্ল্যাটুনসহ বিভিন্ন নামে ঢাকায় দুর্ষর্ধসব অভিযান চালিয়ে এসব গেরিলারা কাঁপিয়ে দেয় পাকিস্তানীদের সুরক্ষিত দূর্গ।
এসব মুক্তিপাগল তরুণদের খালেদ শুধু প্রশিক্ষণ আর দিক নির্দেশনায় দেননি। বীরত্বের সাথে রণাঙ্গনে যুদ্ধও করেছেন। খালেদ মারাত্মক আহন হন কসবা যুদ্ধে। দুই নাম্বার সেক্টরের বীর যোদ্ধারা কসবা শত্রুমুক্ত করে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে। যুদ্ধে একটি শেলের ¯িপ্রন্টার খালেদের মাথায় বিদ্ধ হয়। ¯িপ্রন্টারের টুকরো খালেদের মাথার খুলি ভেদ করে ভেতরে ঢুকে যায়। খালেদের ভাগ্য ভালো ঐ ¯িপ্রন্টারটি মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছায়নি। আহত খালেদকে ভর্তি করা হয় লক্ষেèৗর একটি হাসপাতালে। সেখানকার উন্নত চিকিৎসায় সেরে ওঠেন। গুরুতর আহত হলেও উন্নত চিকিৎসা আর লাখো মানুষের দোয়ায় সেরে ওঠেন তিনি। অসুস্থ থাকায় বিজয়ের সময় ঢাকা দখলের অভিযানে নেতৃত্ব দিতে পারেননি খালেদ। ১৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের সময় নিয়াজীর পাশে ছিলেন খালেদের সহযোদ্ধা সেক্টর-টু এর ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার এটিএম হায়দার।
লেখক : প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা : আশিক রহমান ও মোহাম্মদ আবদুল অদুদ