উড়াল সেতু যানজট সমস্যার সমাধান নয় ইকতেদার আহমেদ
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাজধানী শহরসহ গুরুত্বপূর্ণ শহরসমূহের অভ্যন্তরস্থ যানজট সমস্যা নিরসনে উড়াল সেতুকে একটি সমাধান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ সকল দেশে উড়াল সেতু নির্মাণকালীন সর্বাগ্রে যে বিষয়টি বিবেচনা করা হয় তা হলোÑ উড়াল সেতুতে উঠা ও নামার সময় যানবাহনসমূহ যেন কোনো ধরনের যানজটের মুখে না পড়ে এবং উড়াল সেতুর পার্শ্বস্থ নি¤েœর সড়কের প্রসারতার যেন হ্রাস না ঘটে। তাছাড়া উড়াল সেতু নির্মাণকালীন এমনভাবে পরিকল্পনা করা হয় যাতে তা শহরের সামগ্রিক যানবাহন চলাচলের গতিকে কোনো স্থানে সøøথ না করে দেয়। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশ শহরের অভ্যন্তরে উড়াল সেতু নির্মাণের পরিবর্তে টানেল, ইউলুপ, বিভিন্ন মোড় বা ইন্টার সেকশনে চতুরমুখী ওভারপাশ ও আন্ডারপাস নির্মাণ করে যানজট সমস্যা সমাধানে অধিকতর সফলতা পেয়েছে। পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহের শহরের অভ্যন্তরস্থ সড়কসমূহ আমাদের এরপর পৃষ্ঠা ৭, কলাম
দেশের শহরের অভ্যন্তরস্থ সড়কসমূহ হতে অনেক প্রশস্ত। আর এ কারণে ওই সকল দেশে উড়াল সেতুকে বহুতলে রূপ দিতে কোনো ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় না।
বিগত এক দশকে আমাদের রাজধানী শহর ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের অভ্যন্তরে অসহনীয় যানজটের বিষয়টি মাথায় নিয়ে বেশকিছু উড়াল সেতু নির্মাণ করা হয়েছে এবং বেশকিছু নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন। উভয় শহরে ইতোমধ্যে যে সকল উড়াল সেতু নির্মাণ করা হয়েছে এগুলো যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা পরবর্তী শহরে বসবাসরত জনমানুষের মধ্যে ব্যাপক আশার সঞ্চার হয়েছিল যে উড়াল সেতুসমূহ যানজট সমস্যা সমাধানে ফলপ্রসূ অবদান রাখবে। কিন্তু উড়াল সেতুসমূহ চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হওয়া পরবর্তী দেখা গেল খোদ উড়াল সেতুর উপরেই যানবাহনের দীর্ঘ যানজট। তাছাড়া উড়াল সেতুতে উঠা ও নামার পথে যানজট হতে রেহাই পাওয়া অনেকটা দুষ্কর হয়ে দেখা দিয়েছে।
ঢাকা ও চট্টগ্রাম উভয় শহরের অভ্যন্তরে যেসব লোকাল বাস চলাচল করে এগুলোতে যাত্রী উঠা ও নামার জন্য শহরের সড়কসমূহের নির্দিষ্ট স্থান চিহ্নিত করে দেওয়া থাকলেও এসব বাসের চালকরা তা কখনো মেনে চলে না। পৃথিবীর অন্যান্য শহরে সড়কের এরূপ নির্দিষ্ট স্থানে একটি বাস থামা পরবর্তী নির্ধারিত বিরতির পর যাত্রী উঠুক বা না উঠুক প্রস্থান করে। কিন্তু আমাদের দেশে দেখা যায় এরূপ স্থানে একটি বাসযাত্রী পাওয়ার আশায় দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষমান থাকে। অপেক্ষমান থাকাবস্থায় এসব বাসের চালকরা বাসকে সড়কের মধ্যে এমনভাবে আড়াআড়ি করে রাখে যেন পিছনের সমরূপ বাস সেটিকে অতিক্রম করে যেতে না পারে। এভাবে দিনভর দেখা যায় বাস চালকদের মধ্যে যাত্রী পাওয়ার প্রতিযোগিতায় শহরের বিভিন্নস্থানে স্বাভাবিক যান চলাচল ব্যাহত হয়। আবার লোকাল বাসের এ সকল চালক যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী উঠানো-নামানোর কাজ করে। আর এটি করতে গিয়ে তারা প্রায়শই প্রশস্ত সড়কে, উড়াল সেতুতে উঠা ও নামার পথে এবং শহরের বিভিন্ন মোড়ে অহেতুক যানজটের সৃষ্টি করে।
ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন সড়কে ইলেকট্রনিক সিগন্যাল সিস্টেম রয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এরূপ সিগন্যালের ক্ষেত্রে দেখা যায় লাল বাতি জ্বলাবস্থায় কোনো যানবাহন সম্মুখপানে অগ্রসর হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে ব্যয়বহুল এ সিগন্যালিং সিস্টেম সংস্থাপনের পরও দেখা যায় যানবাহনের চালকরা ইলেকট্রনিক সিগন্যালের লাল ও সবুজ বাতির মধ্যে প্রায়শই পার্থক্য খোঁজে পান না। যান চালকদের এমন অবজ্ঞার জন্য প্রতিটি মোড়েই দেখা যায় পর্যাপ্ত সংখ্যক ট্রাফিক পুলিশ যান নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত। ব্যয়বহুল ইলেকট্রনিক সিগন্যালিং ব্যবস্থা যান চালকদের অনিহার কারণে কাক্সিক্ষত ফল দিতে ব্যর্থ হওয়ায় দেশের সাধারণ জনমানুষের মনে প্রশ্নের উদয় হয়েছে যদি ট্রাফিক পুলিশদের হাতের ইশারায় যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে হয় তবে কেন জনগণের প্রদত্ত টাকার অপব্যবহারে বিদেশ হতে আমদানিকৃত ব্যয়বহুল সিগন্যালিং ব্যবস্থার সংস্থাপন?
সরকারের উচ্চ পদে আসীন আমাদের দেশের যে সকল পদধারী চলাচলের সময় পুলিশের প্রটেকশন কার বা গানম্যানের সুবিধাপ্রাপ্ত তাদের নিকট যানজট কোনো ধরনের বিড়ম্বনা নয়। এ সকল পদধারী চলার পথে যানজটের সম্মুখীন হলে তাৎক্ষণিক গাড়ি ঘুরিয়ে উল্টোপথে চলে দ্রুত গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর প্রয়াস নেন। একদা উল্টোপথে যান চলাচল রোধ করার জন্য ঢাকা শহরের বিভিন্নস্থানে যান্ত্রিক প্রতিরোধ ব্যবস্থার সংস্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু সংস্থাপন পরবর্তী দুই দিনের মাথায় যখন প্রজাতন্ত্রের রাজতান্ত্রিক মানসিকতার অর্থমন্ত্রীর গাড়ি উল্টোপথে চলতে গিয়ে এর চাকার টায়ার ফুটো হয়ে যন্ত্রটির সাথে আটকে গেল তখন রাশভারী অর্থমন্ত্রী হুঙ্কার ছুঁড়লেনÑ কার নির্দেশনায় এটির সংস্থাপন করা হয়েছে? অর্থমন্ত্রীর হুঙ্কারের পরদিন দেখা গেল প্রতিরোধ যন্ত্রটি সড়ক হতে উধাও। এ ধরনের মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তি সরকারের উচ্চ পদে আসীন থাকলে শত উড়াল সেতু নির্মাণ করলেও যে যানজট সমস্যার নিরসন হবে না এ দেশের সচেতন জনমানুষের সেটি উপলব্ধি করার বোধশক্তি রয়েছে।
দেশে যেকোনো সড়কের মোড়ে যেকোনো ধরনের যানবাহন বাম দিকে ঘুরতে চাইলে তা সিগন্যালের আওতায় পড়ে না। আর এ কারণে যেকোনো মোড়ে বামের লেন সবসময় যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত থাকার কথা কিন্তু সোজাসুজি যে সকল যান চলাচল করবে এগুলো যদি বামপাশের লেনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে সে ক্ষেত্রে বামদিকে যান চলাচল ব্যাহত হয়। আমাদের যানবাহন চালকদের ট্রাফিক আইন মেনে না চলার প্রবণতার কারণে বামদিকে গমনেচ্ছু যানবাহনের চালকরা হেতুবিহীনভাবে যানজটের কবলে পড়ে কালক্ষেপণে বাধ্য হন।
বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়ার কারণে এখানকার শহরসমূহে পর্যাপ্ত ও প্রশস্ত সড়কের চাহিদানুযায়ী ভূমির যোগান পাওয়া সহজসাধ্য নয়। আর এ কারণে শহরের নিত্য যানজট সমস্যা নিরসনে নীতিনির্ধারকরা উড়াল সেতুকে সমাধান হিসেবে বিবেচনায় নিলেও তা কাক্সিক্ষত ফল দিতে ব্যর্থ হওয়ায় বিকল্প কী পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে যানজট সমস্যার ফলপ্রসূ সমাধান পাওয়া যায় তা ভাবনার বিষয় হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ ভাবনায় মনোনিবেশ করে বিশেষজ্ঞদের নিকট হতে প্রাপ্ত সুপারিশে জানা যায় আমাদের দেশের জন্য সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিলে উড়াল সেতু শহরের অভ্যন্তরে মোটেও উপযোগী নয়। এর সমাধান দিতে গিয়ে তারা যে মতামত ব্যক্ত করেন তা হলো- বিভিন্ন সড়কে ইউ টার্ন ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিলোপ সাধন করে যথোপযুক্ত স্থানে ইউলুপ নির্মাণ, ইন্টার সেকশন বা মোড়ে চতুরমুখী আন্ডার পাস বা ওভারপাস নির্মাণ এবং সকলে যেন ট্রাফিক আইন কঠোরভাবে মেনে চলেন তা নিশ্চিতকরণ।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক