সাজিয়ে রেখেছি শব্দ কথায় আলোর গল্প
বহু বছর আগে, এক সকালে, এক প্রিয় সহকর্মীকে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখেছি। আমাদের অ্যাসাইনমেন্টে যাওয়ার কথা ছিল। যেতে পারিনি। কোনো টি স্টলে দাঁড়িয়ে নাস্তা করার কথা ছিল। করতে পারিনি। সেদিন তার লাল চোখ আমাকেও কাঁদিয়েছিল। কিছু বলতে পারিনি। কেবল জানতে চেয়েছিলাম- কাঁদছিস কেন? সকালকে জলে ভাসিয়ে, বেদনার চোখ তুলে ও বলেছিল- আর পারছি না প্রতীক? এভাবে হয় না।
কাজ শেষে রাতে বাড়ি ফেরার পথে, কিংবা কাজের ফাঁকে, চায়ের আড্ডায়, বহুদিন বহু সহকর্মীর চোখে জল দেখেছি। রিক্সার হুড তুলে হু হু করে কেঁদেছে। চোখের জলে ভিজে গেছে রাত। অফিসে লেখার ফাঁকে কখন কিভাবে চোখে জল এসেছে, আমরা বলতে পারিনি। ফোনের অন্যপ্রান্তের কান্না বহুদিন কাঁদিয়েছে পাশেই বসে থাকা প্রিয় সহকর্মীকে। অফিস থেকে বেরিয়ে, পথে হাঁটতে হাঁটতে, বলা বেদনার গল্পগুলো কেবল শব্দ হয়ে ভেসেছে বাতাসে। আমরা কিছু বুঝতে পারিনি।
এখনো প্রতিদিন আড্ডায়, প্রিয় সহকর্মীদের দীর্ঘশ্বাসে, বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। অনুযোগ, অভিযোগ, নালিশ। সময় যায়। ভাগ্যের চাকা ঘোরে না। পত্রিকার সংখ্যা বাড়ে। অর্থ বাড়ে না। ছোট বাচ্চাটাকে কতদিন বেড়াতে নিয়ে যেতে পারি না- এমন কথা হরহামেশাই শুনতে হয়। টাকার অভাবে ভালো স্কুলে দিতে পারে না সন্তানকে। দিন শেষে বাচ্চার দুধের জন্য এখনো টাকা চাইতে হয় এর ওর কাছে। প্রাসঙ্গিক আরও কত কথা। তারপর বিদায় বেলা ‘দাদা, এক মিনিট’- বলে যে ছেলেটা আড়ালে ডেকে নিয়ে যায়; ওর কথার কোনো সদুত্তর দিতে পারি না বহু বছর। চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। শব্দহীন উচ্চারণে, ব্যর্থতার দায় কাঁধে নিয়ে, বিদায় জানাতে হয় ওকে।
এরই মধ্যে লাবলু ভাই অসুস্থ হলো। এখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন। আকতারুজ্জামান লাবলু। ভোরের কাগজে আমার সাবেক সহকর্মী। কিছুদিন পেয়েছিলাম। সেই কিছুদিন, পরে সম্পর্কের এক দীর্ঘযাত্রার সূচনা করে। লোকদেখানো নয়; সম্পর্ক অকৃত্রিম, অতি প্রাকৃত। দেখা হলেই, কাছে টেনে নেবে হাসিমুখে মানুষটি। সরল, প্রানোচ্ছ্বল। আমি মুগ্ধ। যত না শব্দ উচ্চারণে, তার চেয়ে বেশি কথা তার চোখে, হাসিতে। যেদিন লাবলু ভাইয়ের সঙ্গে তার প্রিয় স্ত্রী আমাদের শিল্পী ভাবী থাকেন, আরও বেশি আলো ছড়ায় চারপাশে। তারা দুই জনই হাসেন। সবুজ স্নিগ্ধ হাসি। সুন্দর করে কথা বলেন। সময় হয়ে ওঠে আলোকিত, শুভ্র। টের পাই, দুই জনরেই ভেতরে আরও দুটি মানুষ আছে। অকৃত্রিম মানুষ। প্রকৃতই মানুষ। যেদিন শুনলাম লাবলু ভাই অসুস্থ, সেদিন থেকেই মনটা ভীষণ উঁচাটন হয়ে আছে। কোনোদিন কোনো সংকটে খুব কাছে থেকে লাবলু ভাইয়ের পাশে দাঁড়াতে পারিনি। দূর থেকে, পরোক্ষভাবে যতটুকু সম্ভব করেছি। কিন্তু তার সঙ্গে হৃদয়ের যে সখ্যতা, সুসংহত অন্তহীন বন্ধন, নিগুঢ় ব্যাক্তি সম্পৃক্ততা- সেখানে কোনোদিন এতটুকু আঁচ পড়তে দেখিনি, বাঁক নেয়নি বিপরীতে। শর্তহীনভাবে, কোনো প্রকার শব্দব্যয় ছাড়াই, তার যে কোনো মত, সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি। নিতে হয়। কেননা তার মতো উজ্জ্বল শোভনময় মানুষের এখন বড্ড অভাব। চোখ বুজলে যে মানুষ ভেসে ওঠে আপাদমন্তক আলোকছটায়, তারাই তো স্বজন। লাবলু ভাই, শিল্পী ভাবী, আমার, আমাদের স্বজন। সহকর্মীর পরিচয়টা নিছক বলার জন্য। হাসপাতালে আমি লাবলু ভাইকে দেখতে যাইনি। পারিনি। ফেসবুকে তার যে ছবি দেখেছি, শুনেছি, রুগ্ন মলিন মুখ, সেখানে আমি নেই, আমরা নেই। তার ওই চোখ, আমার দেখা চোখ নয়। ওই নাক, কপাল, ভ্রু- কেউ একজন অন্ধকারে এঁকে দিয়েছে। ভুল এঁকেছে। পরিপাটি চুলের সিঁথিতে যে মলিন রেখা, সে পথ ভুল গলিতে ঢুকেছে। দুধ সাদা বিছানা, শুভ্র নার্স, সাদা অ্যাপ্রুন; কিছুই আমাদের না। একদিন, ঠিক সময় মতো, ঠিকই প্রজাপতির ডানায় চেপে, সেই প্রিয়তমা স্ত্রী, সহকর্মীদের মাঝে আবার ফিরে আসবেন তিনি।
তাকে ফিরতে হবে। আবার ঠিক সেই অবিকল চেহারায় সামনে এসে দাঁড়াতে হবে আমাদের। সফেদ পরিপাটি শার্ট-প্যান্ট, কপালে ভাঁজ, হাসিমুখ। সেই একই আদল, সব অবিকল। রেখে যাওয়া আড্ডা, সজলের চায়ের দোকান, পথের মোড়- সব ঠিকই আছে। অফিসের নিচের আইল্যান্ড আরও সুশোভিত হয়েছে। ফুটপাতের হট্টগোল কমেছে। ক্লান্ত রিক্সা চালক চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়ে এখনো চকিত দেখে নেন যাত্রী। সব আগের মতোই। গল্পে মুখর, আলোময়। আমি আপনাকে দেখতে যাইনি। পারিনি। দূর থেকে আলো জ্বেলেছি। রাতে জানালার ফাঁক গলে যে অন্ধকার গলি, তার মাথায় আপনাকে দেখেছি। আলো দেখেছি। শরীরময় আলো। শিরিষের ডালে আলো। রিক্সার টুং টাং শব্দে আলো। রাত জাগা পাখি, পথ চলা মানুষ, নৈশ প্রহরী- সবখানে আলো।
লাবলু ভাই, এসবই আপনার জন্য। আপনি আসবেন বলেই আমরা শব্দ কথায় আলোর গল্প সাজিয়ে রেখেছি। আপনার জন্যই ভালবাসার প্রহর গুনছি। আপনি এলেই আমরা গাইব গান। সম্প্রীতি সৌহার্দ্যরে গান। আপনি এলেই কেবল মলিন মুখ সময়গুলো প্রীতিময় উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। শব্দময় হয়ে উঠবে আমাদের বধির কান।
লেখক : সাংবাদিক, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী
সম্পাদনা : আশিক রহমান ও মোহাম্মদ আবদুল অদুদ