মোঘল সা¤্রাজ্যের প্রতীক ঐতিহাসিক সাত গম্বুজ মসজিদ
ওমর শাহ
ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রান্তে জড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক সাতগম্বুজ মসজিদ। এই ঐতিহাসিক মসজিদের কথা কে না জানে। ঢাকার অনেক মানুষ সাত মসজিদ না দেখে থাকলে ও সাত মসজিদ রোডের নাম সবাই শুনেছে। ষোড়শ শতাব্দির মোঘল ইসলামি ঐতিহ্যের রাজসাক্ষী হয়ে চারশত বছর ধরে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই মসজিদ। যা ইতিহাসে মুসলিম স্থাপত্য শৈলীর ঐতিহ্য-অবদানের কথা মনে করিয়ে দেয়। সাড়া বাংলা জুড়ে যেই স্থাপত্য-শৈলীর কারুকার্য বিদ্ধমান। মনে করিয়ে দেয় চারশত বছর আগের মোঘল রাজা-বাদশাহদের ইসলামি চেতনা ও ঐতিহ্যের স্বর্নালী যুগের কথা।
এই ঐতিহাসিক সাতগম্বুজ মসজিদ ঢাকার ঐতিহ্যবাহি মোহাম্মদপুরে অবস্থিত। মোঘল শাসন আমলে নির্মিত মসজিদটি। দেখতে খুব ছোট হলেও মসজিদটি চারটি মিনারসহ সাতটি গম্বুজের কারণে মসজিদের নাম হয়েছে ‘সাতগম্বুজ মসজিদ’।এটি মোঘল আমলের অন্যতম নিদর্শন। মোঘল মুসলিম ইতিহাসের এক রাজসাক্ষী। মসজিদের মূল ফলকটি হারিয়ে যাওয়ায় বিস্তারিত তথ্যাদি পাওয়া যায়নি। তবে এতটুকু জানা যায় যে ১৬৮০ সালে মোগল সুবাদার শায়েস্তা খাঁর আমলে মসজিদটি তৈরি হয়েছে। প্রসিদ্ধ তথ্যমতে শায়েস্তা খাঁর আমলে তার পুত্র উমিদ খাঁ মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদটি লালবাগ দূর্গ মসজিদ এবং খাজা আম্বর মসজিদ ইত্যাদি মোঘল স্থাপত্যের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। এর সঠিক অবস্থানটা হচ্ছে ঢাকার মোহাম্মদপুরের কাটাসুর থেকে শিয়া মসজিদের দিকে একটা রাস্তা চলে গেছে বাঁশবাড়ী হয়ে। এই রাস্তাতে যাওয়ার পথে পড়ে সাতগম্বুজ মসজিদ। এই মসজিদটির নির্মাণ শৈলী সম্পর্কে আলোচনা করলে দেখা যায়, এর ছাদে রয়েছে তিনটি বড় বড় গম্বুজ এবং চার কোণের প্রতি কোনায় একটি করে অনু গম্বুজ। যার কারনে একে সাতগম্বুজ মসজিদ বলে নামকরন করা হয় এবং এই নামেই মসজিদটি প্রসিদ্ধি লাভ করে। এর আয়তাকার নামাজকোঠার বাইরের দিকের পরিমাণ দৈর্ঘ্যে ১৭.৬৮ এবং প্রস্থে ৮.২৩ মিটার। এর পূর্বদিকের গায়ে ভাঁজবিশিষ্ট তিনটি খিলান এটিকে বেশ আকর্ষণীয় করে তুলেছে। পশ্চিম দেয়ালে সুন্দর তিনটি মিহরাব রয়েছে। দূর থেকে শুভ্র মসজিদটি অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন ও সুন্দর দেখায়। যদিও মসজিদটির আগে রঙ ছিল লাল গোলাপি। যেমন লালবাগ দূর্গসহ বাংলাদের প্রায় পুরাতন স্থাপত্যের রঙ ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ প্রতœতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের আয়ত্বে এই স্থাপত্যগুলোর দেখাশোনার দায়িত্ব অর্পিত হওয়ার পর থেকে তারা সব পুরাতন স্থাপত্যকে শুভ্র-সাদায় রুপান্তর করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই জন্যেই মসজিদটিকে শুভ্রসাদায় খুব সুন্দর দেখা যায়। মসজিদের ভিতরে ৪টি কাতারে প্রায় ৯০ জনের মত মুসল্লীর নামাজ পড়ার মত স্থান রয়েছে। মসজিদের পূর্বপাশে এরই অবিচ্ছেদ্য অংশে হয়ে রয়েছে একটি সমাধি। অবশ্যয় এখন মসজিদ ও সমাধির মাঝে একটি ফুলের বাগান ও বাঁশবাড়ির রাস্তা প্রতিবন্ধক হয়ে আছে। কথিত আছে, এই সমাধিটি শায়েস্তা খাঁর মেয়ের সমাধি। সমাধিটি ‘বিবির মাজার’ বলেও খ্যাত। এ কবর কোঠাটি ভেতর থেকে অষ্টকোনাকৃতি এবং বাইরের দিকে চতুষ্কোনাকৃতির। বেশ কিছুদিন আগে সমাধিক্ষেত্রটি পরিত্যক্ত এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত ছিল। বর্তমানে এটি সংস্কার করা হয়েছে। মসজিদের সামনে একটি বড় উদ্যানও রয়েছে। একসময় মসজিদের পাশ দিয়ে বয়ে যেত বুড়িগঙ্গা। মসজিদের ঘাটেই ভেড়ানো হতো লঞ্চ ও নৌকা। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় তা কল্পনা করাও কষ্টকর। বড় দালানকোঠায় ভরে উঠেছে মসজিদের চারপাশ। এখনকা সেই বুড়িগঙ্গার কথা বললে মানুষ গল্প মনে করবে। অথচ এই মসজিদের গা ঘেঁষে কলকল করে বয়ে যেত বুড়িগঙ্গার ঢেউ। দিন দিন জনবসতি হতে হতে বুড়িগঙ্গা ও জন¯্রােতে বিলিন হয়ে যাচ্ছে।
মসজিদের পশ্চিমে মান্ধাতা আমলের পুরাতন একটি অজুখানা হাউজ আছে। খোলা আকাশের নিচে এই পুরাতন নোংরা হাউজটি ঐতিহাসিক মসজিদের সাথে কোনভাবেই মানানসই নয়। শেওলা ধরা অপরিস্কার ও বসার জায়গা ভাঙ্গা ভাঙ্গা। যদিও ইদানিং পশ্চিম উত্তর কোণে সুন্দর অজুখানা করা হয়েছে। মসজিদের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে এড়িয়ার ভিতরে প্রায় দেখি চিতুই পিঠা বিক্রি করা হয়। নোংরা করে রাখে সেই জায়গাটা। এটা অবশ্যয় মসজিদের মান ক্ষুণœ করার মত ব্যপার। এই ক্ষেত্রে মসজিদের পবিত্রতা মর্যাদা রক্ষা করা উচিৎ।
মসজিদটিতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ হয়। স্থানীয় মুসল্লি ছাড়াও এতে নামাজ আদায় করে দূরদূরান্ত থেকে পরিদর্শনে আসা পর্যটকবৃন্দ। দুই ঈদের ও বিশাল জামাত অনুষ্ঠিত হয়। মসজিদ সংলগ্ন মাঠটি মুসল্লিতে ভরে যায় কানায় কানায়। রাস্তার উপড়ে ও মানুষ নামাজ আদায় করে। মসজিদের পূর্ব দিকে পুরাতন কিছু কবরস্থান রয়েছে। ধারনা করা হয় শায়েস্তা খাঁর ছেলে উমিদ খাঁর পরিবারের কারো কবর হবে। অনেক সময় এই কবরগুলোর প্রাচীরে মানুষজন খোশ গল্পে মেতে থাকে। মোবাইলে গান শোনে এটা কোনভাবেই ঠিক না। এই ব্যপারগুলো কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা উচিৎ। চারশত বছর পুরানা এই ঐতিহ্য-স্থাপত্য মোঘল মুসলিম ইতিহাসেরই এক উজ্জ্বল সাক্ষ্যি। তাই পর্যটকদের ভীর সর্বদা লেগেই থাকে এইখানে। শুধু দেশি নয় বিদেশি পর্যটকদের দল প্রায় পরিদর্শনে আসে ঐতিহাসিক সাতগম্বুজ মসজিদটিকে। পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণে মসজিদের পূর্ব পাশে তৈরী করা হয়েছে বিশাল দৃষ্টিনন্দন হরেক রকম ফুলে সমাদ্রিত ফুলের বাগান। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা দেভদারু গাছসহ কলাবতি রঙ্গন মালতি গোলাপ নানা রঙের ফুল দর্শকদের মুগ্ধ করে। মসজিদটি ছোট হলে ও আকর্ষণীয় সাতটি গম্বুজ দর্শনার্থীদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। মসজিদটি ছোট হওয়ায় সামনে মোজাইক করে অতিরিক্ত মুসল্লিদের নামাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। চারশত বছরের ঐতিহ্য রক্ষায় এই মোজাইক করা স্থানটিতে ছাদ দেয়া হয়নি। তাই খোলা আকাশের নিচে প্রায়ই বৃষ্টিতে ভিজতে হয় মুসল্লিদের। আবার প্রচ- রৌদ্রের তাপে প্রখর গরমে নামাজ আদায় করতে হয়। শুধু জুমার নামাজ আর রমজানে সামিয়ানা টানানোর ব্যবস্থা করতে দেখেছি। মুয়াজ্জিন ও ইমামদের বেতন দেয়া হয় জনগণের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে। একটা মসজিদ কমিটি ও আছে নামে মাত্র। এই ঐতিহ্য কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদের মাইকগুলো জীর্ণশীর্ণ। ঐতিহ্যের এই মসজিদটিতে আজানের আরোও উন্নত ব্যবস্থা করা যেত। মসজিদের উত্তর পশ্চিম কোণে বড় বড় ফাঁটল দেখা দিয়েছে। নিচের দিকে ঢেবেও গিয়েছে একটুখানি। অথচ সংস্কারের কোনো বালাই নেই। জনগণ ও মুসল্লিদের দাবি সরকার মসজিদটির যথাযত সংস্কার করে মুসল্লিদের নামাজের ও পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গহণ করবে। যেন মানুষ জানতে পারে ষোড়শ শতাব্দির মুসলিম ইতিহাসে মুসলমানদের ইসলামি ঐতিহ্য-অবদানের কথা। এই সাত গম্বুজ মসজিদ ষোড়শ শতাব্দির মোঘল শাসনের স্থাপত্যরীতিরই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যা কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জানান দিচ্ছে সেই ষোড়শ শতাব্দির মুসলিম ঐতিহ্য অবদানের কথা। বাদশাহ জনগণের ধর্মীও অনুভূতি ও ইসলামি চেতনার কথা।