রোহিঙ্গা আর রাখাইন কাহিনী
নদীর নাম নাফ। এঁকেবেঁকে ছুটে চলেছে স্রোতস্বিনীটি পাহাড়-সমতলের গা ঘেঁষে বঙ্গোপসাগরের দিকে। একপাশে বাংলাদেশের টেকনাফ, আরেক পাশে মিয়ানমারের রাখাইন। এককালের স্বাধীন আরাকান রাজ্য। এখানে বসবাস করছে যারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তারা ইতিহাসের বিবর্তনের ঘূর্ণিপাকে পড়ে নাম ধারণ করেছে রোহাং থেকে রোহিঙ্গা। এরা মূলত আদিকাল থেকেই মুসলমান। মিয়ানমারের অন্যান্য অঞ্চলের বাসিন্দারা, শতাধিক ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী ছাড়া, প্রায় সবাই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। ইতিহাস সাক্ষী, রোহিঙ্গারা রাখাইনের আদি অধিবাসী। কিন্তু সেনানিয়ন্ত্রিত মিয়ানমার সরকার মনেপ্রাণে চাচ্ছে রাখাইনকে সম্পূর্ণ রোহিঙ্গা শূন্য করতে। আর তাই ১৯৮২ সালে চালু করে বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন যার ভিত্তিতে সরকার রাখাইনদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়। এখন তারা বলছে, রোহিঙ্গারা বাঙালি, তারা মুসলমান এবং বাংলাদেশি। অথচ ইতিহাস বলে ভিন্ন কথা।
রোহিঙ্গাদের কারো জানাই নেই, তার বাপ-দাদা-পরদাদারা কোথা থেকে কখন বাংলাদেশ-বার্মা সীমান্তের এই আরাকান-রাখাইন অঞ্চলে এসেছিল। রাখাইনের সাগর-বিধৌত নীল আকাশের গায়ে হেলান দেওয়া পর্বতমালা ঘেঁষে শ্যামল স্বপ্নীল পাদদেশে বসবাস করছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। কখনো তাদের মাথায় এ চিন্তাই আসেনি যে তাদেরকে কেউ বলবে, এটা তোমাদের জায়গা নয়, এটা তোমাদের পিতৃপুরুষের ভিটা নয়। একটি দেশ আছে। কিন্তু কেমন সে বাংলাদেশ, কেমন সেখানকার মানুষ, কিছুই তাদের জানা নেই। শিশুকাল থেকেই সবাই দেখে আসছে ওপারে নদীর ঢেউ খেলানো জলরাশিতে ভেসে বেড়াচ্ছে কত কত পাল তোলা নৌকা, দক্ষিণে ছুটে চলেছে তরঙ্গমালার গলা জড়িয়ে সাম্পান আর ঢেউ-এর তালে তালে এগিয়ে যাচ্ছে বড় বড় জাহাজ কোনো এক দ্বীপের দিকে। শুনেছে তারা, সেন্টমার্টিন নামে আছে নাকি অপূর্ব সুন্দর এক ‘দারুচিনি দ্বীপ’। নদীর ওই দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকে আর ভাবে কেমন জানি বাংলাদেশের মানুষগুলো। ওরাও কী মিয়ানমারের জঙ্গি বৌদ্ধদের মতো, নাকি বর্বর মগ-সেনাদের মতো। এমনি ভাবনার মধ্যেই একদিন দেখে রাতের অমানিশায় হঠাৎ আলোর ঝলকানি, পুঞ্জ পুঞ্জ ধোঁয়া আর বুক কাঁপানো গুলির আওয়াজ। আর্তনাদ, করুণ আর্তনাদ চারদিকে। ছোট্ট শিশুদের হৃদয়-বিদারক কান্না, নারীদের আর্তনাদ, বৃদ্ধদের চিৎকার, জবাই-করা মানুষের মৃত্যু-গোঙানি আর আগুনে পোড়া বাড়িতে দগ্ধ হওয়া মানবদেহের উৎকট গন্ধ। শুধুই ধ্বংসযজ্ঞ। চারদিকে বাড়ি-ঘর পুড়ছে, উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা আগুনে ছুঁড়ে দিচ্ছে রোহিঙ্গাদের আর অদূরে বর্বর বার্মিজ সেনাদের উদ্বাহু নৃত্য। পাগলের মতো দলে দলে মানুষ ছুটছে সে-ই এতদিন শোনা বাংলাদেশের সীমান্তের দিকে। ভেবে পায় না তারা, হঠাৎ কেন এমন হলো?
তারা কখনো জানতেই পারেনি, চক্রান্ত অনেক সুদূরপ্রসারী। মুসলিম অধ্যুষিত রাখাইন-এর দশ লক্ষাধিক নাগরিককে বাংলাদেশের ভিতরে তাড়িয়ে দিতে পারলে খনিজ-সমৃদ্ধ রাখাইন হবে সেনানিয়ন্ত্রিত মিয়ানমারের গণহত্যার নায়কদের বিশাল ভূমিসম্পদ, গড়তে পারবে তারা সেখানে অর্থনৈতিক অঞ্চল, শিল্প-কারখানা। মহাজ্ঞানী বুদ্ধের অনুসারি তারা মনে হয় বোঝেছে, বুদ্ধের অমৃত বাণী ‘জীব হত্যা মহাপাপ’ তা ঠিক, তবে রাখাইনের রোহিঙ্গারা যেহেতু জীব নয়, শুধুই চলাফেরা করতে পারা একধরনের প্রাণি, তাদেরকে হত্যায় কোনো পাপ নেই, মহাপাপ তো দূরের কথা।
রোহিঙ্গাদের জোর করে মিয়ানমার সরকার বাস্তুচ্যুত করেছে। বিগত কয়েক বছর ধরে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাসহ ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশে। চক্রান্ত তো অনেক আগে থেকে শুরু। নিজভূমে পরবাসী রোহিঙ্গারা দলে দলে বহু বছর থেকেই এসে ভিড় করেছে বাংলাদেশে। যদিও ২৫ আগস্ট ২০১৭ থেকে শুরু হওয়া রোহিঙ্গা আগমনই সবচেয়ে বেশি- ছয় লক্ষাধিক। এদের হঠাৎ আগমন বাংলাদেশ ভূখ-ে সৃষ্টি করেছে তীব্র মানবিক সংকট। আগমন এখানেই শেষ নয়। ওরা আসছে, আরও আসবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না রোহিঙ্গা-বিদ্বেষী মিয়ানমার প্রশাসন ইচ্ছাকৃত জাতিগত নিধন না থামাবে কিংবা রাখাইন রোহিঙ্গা শূন্য না হবে। লক্ষণে তা-ই মনে হয়। আর তাদের সাথে আসছে অনাকাক্সিক্ষত অনেক কিছু। মাদক, এইচআইভি-এইড্স, ক্ষুধা, সামাজিক অপরাধ, সমাজের প্রতি তীব্র ঘৃণা আর ক্ষোভ। নজিরবিহীন এই মানবিক সংকটে ভীত না হয়ে বুক আগলে গ্রহণ করে তাদের আশ্রয়-খাবার-ঔষধপত্র-ভালোবাসা দিয়েছে ও দিচ্ছে হিমালয়সম মনের অধিকারী অকুতোভয় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বাংলাদেশ।
কিন্তু এখানেই তো সব কিছু থেমে থাকবে না। বিশাল সংখ্যক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় তো দেওয়া হলো, তারপর? তারপরের ব্যাপারটা তো ভবিষ্যতের গহ্বরে। এখন বাংলাদেশকে উঁকি দিতে হবে এই ভবিষ্যতের গহব্বরে, দ্রুত কিন্তু সাবধানে। গহবরের মুখে হোঁচট খাওয়া যাবে না। পড়ে যাওয়া চলবে না। খুঁজে আনতে হবে বাঁচার কৌশল। আর তার জন্য প্রয়োজন চৌকষ নেতৃত্ব, এক দল ত্যাগী মানুষ যারা মাটির তলায় বিষ পুঁতে রেখে সাগর মন্থন করে আনতে জানে অমৃত। এরাই হবে কুশলী পরিকল্পনাবিদ আর দক্ষ ব্যবস্থাপনা বিশারদ। এখন জরুরি দরকার সুচিন্তিত পরিকল্পনা এবং নিপুণ ব্যবস্থাপনা। কেন এমনটা দরকার বলে মনে করছি? জানতে হলে বুঝতে হবে মিয়ানমারের মতো সর্বদিক থেকে জটিল দেশটির কথা। যুগ যুগ ধরে সামরিক শাসকদের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত দেশটির রাজনীতি, কূটনীতি, সমাজনীতি আর সামরিক ও ধর্মনীতির বিষয়গুলো। এর সাথে আরও বুঝতে হবে অন্যান্য দেশে চলমান জাতিগত বিদ্বেষ, নৃশংসতা, জাতিগত নিধন আর উচ্ছেদ ও বিপ্লবের পেছনের আন্তর্জাতিক চক্রান্তের কথা।
লেখক : কলামিস্ট ও শিক্ষাবিদ; উপাচার্য, বাংলাদেশ উ›মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়