প্যারাডাইস পেপারসে বাংলাদেশের কারও নাম থাকাটাই স্বাভাবিক
রাজেকুজ্জামান রতন
প্যারাডাইস পেপারস বিশ্বের ক্ষমতাধর নেতাদের গোপন সম্পদের একটা ফাঁস করা তথ্যভান্ডার। এর আগে আমরা পানামা পেপারসের মধ্য দিয়েও এরকম অনেক ক্ষমতাসীন নেতা নেত্রীদের সম্পদের তথ্য দেখেছিলাম। রাজনীতিতে, বিশেষ করে পুঁজিবাদী রাজনীতিতে ক্ষমতা ও লুটপাট হাত ধরাধরি করে চলে, তার একটা দৃষ্টান্ত হচ্ছে কখনো পানামা পেপারস বা কখনো প্যারাডাইস পেপারস। আমরা দেখেছি যে, পুঁজিবাদী সে সমস্ত দেশগুলো যারা জনগণের উপর কর্তৃত্ব করার জন্য রাজনীতি করে, যারা জনগণের প্রতি দায়িত্ব বা জনগণের সেবা করার জন্য নয়। জনগণের সম্পদ, পাকৃতিক সম্পদ গোটা দুনিয়ার সম্পদ ভাগ বণ্টন করার জন্য পুঁজিবাদি বা সা¤্রাজ্যবাদী রাজনীতি করে। তার সঙ্গে যারাই যুক্ত আছেন, তারা কেউ দুর্নীতির বাইরে থাকতে পারছেন না। একসময় বলা হতো যে, ‘ চড়বিৎ পড়ৎৎঁঢ়ঃং, ধনংড়ষঁঃব ঢ়ড়বিৎ পড়ৎৎঁঢ়ঃং ধনংড়ষঁঃবষু’ । সেখানে আমার দেখছি, নির্মম সত্যি হচ্ছে, যেখানে ক্ষমতা কুক্ষিগত হচ্ছে, সেখানেই দুর্নীতি হচ্ছে। এবং এই ক্ষমতার সাথে দুর্নীতির একটা বন্ধন সৃষ্টি হচ্ছে। সেটি একটি দিক। আর একটি দিক হচ্ছে, জনগণ যত ক্ষমতাহীন হচ্ছে, দুর্নীতিটা তত লাগামহীন হয়ে যাচ্ছে। একদিকে গণতন্ত্রের চেতনার অনপুস্থিতি, গণতান্ত্রিক সংগঠনগুলোর দূর্বলতা, সরকারগুলোর জবাবদিহিতা না থাকা, দুর্নীতি এবং টাকা লুটপাট করে পাচার করার একটা অবাধ সুযোগ থাকা। এরা প্রত্যেকে দেখবেন নিজের দেশের সম্পদ বাইরে পাচার করতে উৎসুক। এই যে সম্পদ পাচারের একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে আমরা দেখছি, মানুষ এমনিই দূর থেকে তাদের ধিক্কার দিচ্ছে, কিন্তু এটার বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে উঠছে না। ফলে এই মানুষগুলো কিন্তু এখনো বার বার ঘুরে ঘুরে দেশে ক্ষমতায় আসে। এটার মধ্য দিয়ে আমরা দেখেছিলাম অক্সফাম একটি রিপোর্ট দেখিয়েছিল, পৃথিবীর আটজন মানুষের কাছে ৩৬৫ কোটি মানুষের সম্পদ কেন্দ্রিভুত হয়ে গেছে। আমেরিকাতে একটা মুভমেন্ট হয়েছিল, ৯৯/১ যে, ১ভাগ মানুষ পৃথিবীর ৯৯ ভাগ মানুষের সম্পদ কেন্দ্রিভুত করে রেখেছে। বাংলাদেশে যেটা আমরা দেখেছি, বাংলাদেশের দশভাগ মানুষ গোটাদেশের ৪৭ ভাগ সম্পদ কেন্দ্রিভুত করে রেখেছে। এমনি করে পৃথিবীর প্রত্যেকটা দেশে আমরা দেখলাম পুঁজিবাদ এবং লুটপাট তারা হাতেনাতে তৈরী করছে।
এর বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ তৈরী হচ্ছে এবং সেই ক্ষোভটাকে একটা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যে জাগরণে পরিণত করা দরকার। তা না হলে এই দুর্নীতিকে লাগাম টেনে ধরা যাবে না, উচ্ছেদ করা যাবে না। বাংলাদেশে কারও নাম না আসলে আমরা অবাক হব। কারণ, বাংলাদেশ নিয়ে ইতিমধ্যে সুইস ব্যাংকে টাকা রাখার কথা শুনেছি, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমস তৈরী করায় দ্বিতীয় স্থানে চলে এসেছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশীদের নাম না থাকাটা অস্বাভাবিক। বাংলাদেশের কারও কারও নাম থাকাটাই এখানে স্বাভাবিক। কারণ, এটাতো ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হয়েছে, যেমন সুইজার্যলান্ড, মালয়েশিয়া এবং কানাডায় বাংলাদেশির কি পরিমান সম্পত্তি আছে। এর বাইরে যদি আমরা দেখি আমাদের ক্ষমতাসীনদের সামান্য কোনো রোগ হলেই বিশ্বের ব্যয়বহুল দেশগুলোতে চিকিৎসার জন্য চলে যান। তাদের এই সম্পদের উৎস কী? স্বাভাবিকভাবে কেউ এই টাকা আয় করতে পারে? তা হলে আমার মনে হয়, আমাদের এখানে দুর্নীতির যে বিরাট বিস্তার আছে, আমাদের দেশে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, কালো টাকার একটা সমান্তরাল প্রবাহ আছে, আবার রাষ্ট্রপতিও বলেছিলেন, যে সংসদ কিভাবে একটা টাকাওয়ালাদের ক্লাবে তৈরী হচ্ছে। বেসিক্যালি প্রতিদিন দুর্নীতি লাগামহীনভাবে হচ্ছে।
আমাদের ফ্লাইওভারে দুর্নীতি হচ্ছে, হাইওয়েতে দুর্নীতি হচ্ছে, সেতুতে দুর্নীতি হচ্ছে, এমনকি আমাদের বিদ্যুৎ কেন্দ্রেও দুর্নীতি হচ্ছে। এই দুর্নীতির টাকাটা কোথাও না কোথাও কোনো না কোনোভাবে কারও পকেটে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যেমন ৮শ কোটি টাকা পাচার হয়েছে সেটা দেখেছি, আবার সোনালী ব্যাংকের ৪ হাজার কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংকের ৬ হাজার কোটি টাকা।
এগুলোতো আমরা দেখেছি। টাকা গুলো কারও না কারও মাধ্যমে, কারও না কারও পকেটে গিয়েছে। এটা বড় দুর্নীতি। তাই সামনে প্যারাডাইসের পেপারসে বাংলাদেশের কারও নাম না থাকাটাই অস্বাভাবিক।
পরিচিতি : কলামিস্ট ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাসদ
মতামত গ্রহণ : গাজী খায়রুল আলম
সম্পাদনায় : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ