সরেজমিনে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে এলাম
রোহিঙ্গাদের ইতিহাস একটি বর্ণাঢ্য ইতিহাস। জীবনে নিরাপত্তার স্বাদ তারা জন্ম থেকেই পায়নি। পুরুষানুক্রমে যুগ যুগ ধরে বসবাস করেও রোহিঙ্গারা নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত। জন্মসূত্রে নাগরিক হওয়ার যে আন্তর্জাতিক বিধান রয়েছে তা রোহিঙ্গাদের ভাগ্যে জুটেনি কোনো দিন।
১৯৮৯ সালের ১৮ জুনের পূর্ব পর্যন্ত মিয়ানমার পূর্ব ইংরেজি নাম ছিল বার্মা। বৃটিশ শাসনামলে অং সান সুচির পিতা অং সান তার সাথীদের নিয়ে বার্মায় গড়ে ছিলেন ‘দোবামা আসিওনে’ (আমাদের বার্মা) নামে একটি রাজনৈতিক দল। মিয়ানমারে উগ্র বৌদ্ধদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল ‘নাডালা বাহিনী।’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪১ সালে অং সান জাপানের সাথে হাত মেলায় এবং গড়ে তোলে বর্মি জাতীয় সরকার। পরে ১৯৪৫ সালের শুরুতে হাত মেলায় গ্রেট বৃটেনের সাথে। ১৯৪৭ সালে ‘দোবামা আসিওনে’ দলের মধ্যে সৃষ্টি হয় গভীর তাত্ত্বিক মতবিরোধ। তাদেরই একটি অংশ আং সান ও তার সমর্থকদের হত্যা করে। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বার্মা স্বাধীনতা লাভ করে। বার্মার প্রথম প্রধানমন্ত্রী উ-নু বৌদ্ধবাসী সমাজতন্ত্রের সূত্রপাত ঘটান। ১৯৬২ সামরিক অভ্যুত্থানে সেনাপতি নে-উইন ক্ষমতায় আসার পর থেকে সেখানে গণতন্ত্র আলোর মুখ দেখেনি। ১৯৭৪ আরাকানের নাম বদলিয়ে রাখাইন রাখা হয়।
সাম্প্রতিক ঘটনা ছাড়াও প্রতিনিয়তই রোহিঙ্গাদের উৎখাত করা হয় বিভিন্ন অজুহাতে। অজুহাত যা-ই হোক না কেন এর মূল কারণ উগ্র বৌদ্ধত্ববাদ। বৌদ্ধরা মুসলমানদের সহ্য করতে না পারার কারণেই সেখানে মুসলিম ও বৌদ্ধদের সহ-অবস্থান চলেছে না। যেমন সহ-অবস্থানের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রয়েছে বাংলাদেশে। ৪/১১/১৭ তারিখে রূপগঞ্জের প্রায় ৬০ জন সহকর্মী নিয়ে নিজেদের উদ্যোগে সংগ্রহ করা ত্রাণ নিয়ে উখিয়া উপজেলাধীন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাই। দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনা কর্মকতাদের অনুমতি নিয়েই কুতুপালং ৫ নং ক্যাম্পে শরণার্থী রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলি। রাশিদং জেলার দোকান মালিক নুরুল ইসলাম জানান, তাদের গ্রামে ৪০০ লোকের বসবাস তন্মধ্যে ৭০ জনকে সেনাবাহিনী ধরে নিয়ে গেছে যাদের এখনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। রাঙ্গাবালী প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক আবুল হোসেন বলেন, রোহিঙ্গাদের পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। সাহায্যের পরিবর্তে নাগরিকত্বই তাদের প্রধান দাবি বলে মন্তব্য করেন। নুরু সালাম এলাকার মো. ইলিয়াস জানান, তার পিতা-মাতাকে হত্যা করে পুড়িয়ে দিয়েছে। বালিবাজার এলাকার ৩ হাজার জনের মধ্যে ২ হাজার ৫০০ জনই বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। আকাইব জেলার নেছাপুর গ্রামের শাহ আলম জানান, মিলিটারি মুসলমান রোহিঙ্গা দেখলেই গুলি করে হত্যা করে। ঐ জেলায় রাফাইলি এলাকায় সৈয়দ আলম জানান, রোহিঙ্গা মুসলমান দেখলেই দৌঁড়িয়ে দৌঁড়িয়ে মিলিটারি গুলি করে এবং পিতা-মাতা স্বামীর সামনেই মহিলাদের ধর্ষণ করে। আকাইব জেলার ফকিরা বাজার এলাকার মির্জা আহাদ জানান, তার ভাইকেসহ তাদের গ্রামের প্রায় ১০০ জনকে মেলিটারিরা হত্যা করেছে। থামি এলাকার ইসলাম জানান, হালচাষী তার ভাই নুরু আলমকে হত্যা করা হয়েছে। সাহেব বাজার এলাকায় হাজরা খাতুন জানান, তার স্বামী ইলিয়াসকে হত্যা করার পর সে তার সন্তানদের নিয়ে পালিয়ে এসেছে। এ ধরনের প্রায় শতাধিক পুরুষ, মহিলা, কিশোর, যুব-যুবতী রোহিঙ্গাদের সাথে নিবিড়ভাবে আলাপ করলাম। রোহিঙ্গাদের সব ভাষা পরিষ্কার বোঝা না গেলেও তাদের আকুতিতে মনে হয় যে, তাদের বাঁচার একটি আন্তর্জাতিক অধিকার রয়েছে তা তারা উপলব্দি করতে পারছে না। তাদের সাথে আলোচনার সময় কমিনিউটি রেডিও নাফ ৯৯.২ এফএম প্রতিনিধি (১) সাদ্দাম হোসেন এ্যানি, (২) হামিদা আখতার, (৩) রোজিনা আখতার, (৪) বিয়াসালউদ্দিন ভাষাগত সমস্যায় আমাকে সহযোগিতা করেন। ঘটনার বিবরণ দেওয়ার সময় রোহিঙ্গাদের চোখে মুখে যে হৃদয় বিদারক চিহ্ন ফুটে উঠেছে তাতে প্রতীয়মান হয়, মিয়ানমার বৌদ্ধরা সব বর্বরতার রেকর্ড ভঙ্গ করে বর্বরতার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে।
রোহিঙ্গাদের সাথে দীর্ঘ সময় আলাপ করে তাদের সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে যা জানা গেলো, তা খুবই কষ্ঠদায়ক। শুরু থেকেই তাদের সেখানে সিডিউল কাস্ট হিসাবে ট্রিট করা হয়েছে। যেমন তাদের কোনো আত্মীয়স্বজন সরকারি কর্মকর্তা বা উচ্চ শিক্ষিত এমন কোনো রেফারেন্স দিতে পারেনি। বিশ্ব বিদ্যালয় পড়–য়া বা পাস করা কোন ছাত্র-ছাত্রীর কথা জানতে পারলাম না। পেশা হিসাবে তারা চাষাবাদ ও খেটে খাওয়ার কাজ করে। তবে সেখানে মার্কেট, গার্মেন্টস প্রভৃতির মালিক রয়েছে বলে জানা যায়। কৃষকদের মধ্যে ধনী কৃষকও রয়েছে। তবে সাধারণত দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে এমন সংখ্যাই বেশি।
একটি বাজারের ভিতরে সরুরাস্তা দিয়ে নি¤œাঞ্চল থেকে উঁচু জায়গায় কুতপালং ৫ নং ক্যাম্পটি অবস্থিত। ক্যাম্পে অগণিত নর-নারী। ক্যাম্পে এখনো যাদের জায়গা হয়নি তাদের স্থান হয়েছে রাস্তার দুই পাশে। পলিথিন দিয়ে তাদের আশ্রয় স্থল বানানো হয়েছে। ক্যাম্পের বাহিরে সরকারি ত্রাণ এখনো পৌঁছায়নি।
গর্ভবতী মহিলাদের সংখ্যাই বেশি। গর্ভবতী হলে বৌদ্ধ মিলিটারি ধর্ষণ করে না, এমন তথ্যও তাদের কথাবার্তা থেকে উঠে এসেছে।
লেখক : কলামিস্ট ও বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা
সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ