বিএনপির রাজনীতির ৯ বছর
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটের ভরাডুবি এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় দীর্ঘ ৯ বছরে আবর্তিত তাদের রাজনৈতিক কর্মকা- নিয়ে জনমনে আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে। মহাজোট সরকারের আমলে বিরোধী দল হিসেবে জনগণের কোনো দাবি নিয়ে তারা রাজনৈতিক মঞ্চে আবির্ভূত হতে পারে নি। বরং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় নিজেদের অবস্থান ছিল অস্পষ্ট। দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নে কোনো ধরনের অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়নি বিএনপির কোনো নেতাকে। আন্তর্জাতিকভাবে নিজেদের ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতেও ব্যর্থ হয় তারা। বরং ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ না করে বেগম খালেদা জিয়া বিতর্কিত হন। আর দুর্নীতির মামলায় নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতে এ পর্যন্ত সক্ষম হননি তিনি। অন্যদিকে বিএনপির কিছু নিবেদিত সমর্থক শ্রেণি থাকলেও ৯ বছরে তাদের অবস্থানও পাল্টে গেছে। কেউ কেউ রাজনীতি থেকে দূরে আছেন। কেউ বা আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন। হরতাল-অবরোধ দিয়ে ঘরে বসে থেকে বিএনপি নেতারা যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা সাধারণ মানুষকে আরও বেশি ভোগান্তিতে ফেলে। কারণ পেট্রোল বোমা আর আগুনে মানুষ পুড়িয়ে মারার ভয়ঙ্কর সংস্কৃতি চালু করেন তারা। ফলে গত ৯ বছরে বিএনপির রাজনীতি বিভিন্ন অভিযোগের কারণেই জনসমর্থন পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। অবশ্য এই সময়ের মধ্যে তারা একাধিক জনসমাবেশ করে দলের কর্মকা- সচল রাখার চেষ্টা করেছে।
২.
গত ৯ বছরে দেশের ভেতর জঙ্গিবাদে মদদদাতা এবং বিদেশি নাগরিক হত্যাকা-ে বিএনপির সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। ২৮ অক্টোবর (২০১৫) দেশের প্রায় সব জাতীয় দৈনিকের প্রধান সংবাদ হচ্ছে, গুলশানে ইতালীয় নাগরিক সিজারে তাভেল্লা হত্যাকা-ের ঘটনায় বিএনপি নেতা এম এ কাইয়ূমের সম্পৃক্ততা। এক মাস আগের ওই ঘটনায় চার আসামিকে গ্রেফতার এবং তাদের একজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির পর পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, একজন ‘বড় ভাই’-এর পরিকল্পনা ও নির্দেশেই তাভেল্লাকে হত্যা করা হয়েছে। বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে বিনষ্ট করা এবং দেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টার অংশ হিসেবে এ ধরনের ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে জানা গেছে। সেসময় সরকারের মন্ত্রী পরিষদের কেউ কেউ বলেছিলেন, ঢাকা ও রংপুরে দুই বিদেশি নাগরিক হত্যা আর পুরান ঢাকার হোসেনী দালানে গ্রেনেড হামলা একই সূত্রে গাঁথা। অন্যদিকে ২৮ অক্টোবর একটি দৈনিকের সংবাদ হলো, বিমানবন্দর থেকে দেশি-বিদেশি যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাই করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার পরিকল্পনা করেছিল জামায়াত-বিএনপি। পত্রিকাটির মতে, হত্যা, সন্ত্রাস, জ্বালাও পোড়াও, অবরোধ-হরতালসহ নাশকতার বিভিন্ন ঘটনা ঘটিয়ে ব্যর্থ হয়ে জঙ্গি গ্রুপগুলোর সদস্যদের মাধ্যমে দেশে নাশকতার পরিকল্পনা করছে এ দুটি রাজনৈতিক দল। অর্থাৎ বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক কর্মকা-ে নাশকতা অনিবার্য বন্ধনে আবদ্ধ। সম্প্রতি পাইলট সাব্বিরকে গ্রেফতার করা হলে বিমান নিয়ে হামলার পরিকল্পনা স্পষ্ট হয়।
আসলে এদেশে বিএনপির হঠকারী রাজনীতির ভয়াবহ দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। ২০১৫ সালের শুরু থেকে বিএনপি ঘোষিত তিন মাস অবরোধ-হরতালে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। সহিংসতার ধারাবাহিকতায় দেশকে সংকটের আর্বতে ফেলে দিয়ে বিএনপি-জামায়াতের নেতারা ঘরে বসে মজা দেখেছেন। রেল লাইনের উপরে ফেলা হয়েছে, পেট্রোল বোমার নাশকতার ছকে বলি হয়েছে গাড়ি চালক থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত। মানুষকে জিম্মি করে কি ফায়দা লুটতে চেয়েছিল ওই রাজনৈতিক দলসমূহ? তারা কি জনগণের কল্যাণ কামনা করে? প্রতি সপ্তাহে যে হারে সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক বেড়েছে বলে মনে হয় না। যদিও তারা প্রচার করছে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জয় তাদের নিশ্চিত। দলীয় হঠকারিতা, নাশকতা ও জঙ্গিপনাকে প্রত্যাখ্যান করছি আমরা। সাংগঠনিকভাবে বিএনপির তুলনায় আওয়ামী লীগ জনগণের পক্ষে কাজ করছে কিনা- এসব বিতর্কে লিপ্ত না হয়েও বলা যায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় এবং ফাঁসি কার্যকর করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।
সেই সংগ্রামে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সদস্যদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ থাকলেও অনেক দিক থেকে তৃণমূল মানুষের সেবায় নিয়োজিত এ দলের নেতাকর্মীরা। পক্ষান্তরে সবজায়গায় ছাত্রদল-ছাত্রশিবিরে আছে হত্যা মামলার আসামি, প্রবাসী, ড্রাইভার, কাজের ছেলে, ভাঙ্গারি, দোকানদার, বয়স্ক, বিবাহিত, সন্তানের জনক, চিহ্নিত বেঈমান, চাকুরিচ্যুত, ব্যবসায়ী এমনকি সাবেক জঙ্গিগোষ্ঠীর নেতারা। যোগ্য, ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের বাদ দিয়ে অর্থের বিনিময়ে ছাত্রদল-ছাত্রশিবিরে কেন্দ্রীয় কমিটিতে অনেক পদ দেওয়া হয়েছে। স্বজনপ্রীতি ও অর্থবাণিজ্য তাদের রাজনীতির চালিকা শক্তি। ছাত্রদলের কমিটিতে আছে বুয়েট ছাত্র সনি হত্যার আসামি (৫ বছর জেলও খেটেছেন) নিয়াজ মাখদুম মাসুম বিল্লাহ। ঢাবি জহুরুল হক হল ছাত্রদলের নেতা খোকন হত্যার আসামি শোয়েব, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজল দেবনাথ হত্যা মামলার আসামি ইমরান হোসেন।
এমনকি গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করার পর ঢাবি জিয়াউর রহমান হলে খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়ার ছবি ভাঙচুর করেছিল এমনসব ব্যক্তিরা বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঢুকে পড়েছে।
তারেক রহমান গ্রেফতার হওয়ার পর যার নেতৃত্বে মধুর কেন্টিনে মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছিল তাকেও দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদ। অর্থাৎ বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে যুগান্তকারী, সাহসী ও দূরদর্শীমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো নেতা নেই। রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে বিএনপি-জামায়াতের গুণগত মান ও উৎকর্ষ একেবারেই শূন্য।
লেখক : অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা : আশিক রহমান ও মোহাম্মদ আবদুল অদুদ