ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও সংখ্যালঘুদের দায়
সা ম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশ। মাঝে মধ্যে কিছু ঘটনা আমাদের সেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির মধ্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করে। প্রতিটি ঘটনার প্রেক্ষাপট প্রায়ই এক। কেন এই ধর্মীয় সংখ্যালঘু যুবকের বিরুদ্ধে ফেসবুক তথা সোস্যাল মিডিয়ায় ধর্ম অবমাননার আভিযোগ? তার পর ধর্মের মানসম্মান রক্ষার জন্য হাজারো মানুষের মিছিল সমাবেশ, এর পর ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘরে হামলা অগ্নিসংযোগ লুটপাট। গত কয়েক বছরে কক্সবাজারের রামু, কুমিল্লার হোমনা, পাবনার সাঁথিয়া, সাতক্ষীরার ফতেহপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, ফরিদপুরের সদরপুর সর্বশেষ শিরোনাম হলো রংপুর সদর উপজেলার ঠাকুরপাড়া গ্রাম। গত সপ্তাহে ফরিদপুরের সদরপুরের হাটকৃষ্ণপুর এলাকায় ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে বিষ্ণু মালো নামের হিন্দু সম্প্রদায়ের এক যুবকের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালায় স্থানীয় ধর্মীয় উগ্রবাদীরা। এর রেশ না কাটতেই গত ১০ নভেম্বর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো রংপুর সদর উপজেলার ঠাকুরপাড়া গ্রামে। গত ৫ নভেম্বর আলমগীর হোসেন নামের এক মুদি দোকানদার টিটু রায় নামের এক হিন্দু যুবকের বিরুদ্ধে ফেসবুকে ধর্ম অবমাননাকর পোস্টের অভিযোগ এনে থানায় মামলা করেন। এর পর থেকেই স্থানীয় ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্টদের মধ্যে ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননাকর পোস্টের কথা প্রচার করে হিন্দুদের প্রতি এক ধরনের বিদ্বেষ সৃষ্টির পায়তারা চালানো হয়। পাঁচ দিনে যা তিল থেকে তালে পরিণত হয়। এই তালেরই বিস্ফোরণ ঘটে ১০ নভেম্বর শুক্রবার জুমার নামাজের পর। যেই টিটু রায়ের বিরুদ্ধে আভিযোগ এনে থানায় মামলা এর পর এতো কিছু সেই টিটু রায় দীর্ঘ সাত বছর যাবৎ দেনার দায়ে পরিবার পরিজন নিয়ে এলাকা ছেড়ে নারায়ণগঞ্জ এসে স্ত্রীসহ কোনো এক পোশাক শিল্পকারখানায় কাজ করছেন। টিটু রায়ের স্বজনদের দাবি, তিনি কোনো লেখা-পড়াই জানেন না। সংবাদ মাধ্যমে আরও যে ভয়ঙ্কর তথ্যটি আমরা পেয়েছি তা হলো টিটু রায়ের ছবি ব্যবহার করে যে ফেসবুক আইডি থেকে ধর্ম অবমাননার পোস্ট দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে সেখানে ইংরেজিতে তার নাম টিটু রায় না লিখে মো. টিটু (এমডি টিটু) লেখা ছিল। সম্প্রতি ফেসবুক কর্তৃপক্ষের দাবি ফেসবুকে প্রায় ২৭ কোটি ভুয়া আইডি আছে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন একটি ফেসবুক আইডি থেকে কে বা করা তথাকথিত ধর্ম অবমাননাকর কি লিখল, বিচার বিশ্লেষণ ছাড়াই ক্ষেপে গেল আমাদের ধর্মপ্রাণ মানুষগুলো। প্রতিটি এই ধরনের ঘটনার পর দেখি হাজার হাজার মানুষ একত্রে হামলা চালায়। স্বাভাবিক ভাবেই আমার প্রশ্ন, ওই হাজার হাজার মানুষ সবাই কি ওই পোস্টটি দেখেছেন? নাকি কোনো বিশেষ মহল নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষগুলোকে ধর্ম অবমাননার কথা বলে উসকে দিচ্ছে? পূর্বের এই ধরনের ঘটনা থেকে আমরা যতটুকু শিখেছি তাতে রংপুরের এই ঘটনার জন্য কিন্তু সেখানকার হামলাকারীদের পাশাপাশি প্রশাসন জনপ্রতিনিধি রাজনীতিবিদ কেউ কম দায়ী নয়। উত্তেজনা চলছিল কয়েক দিন ধরেই।
তবে কেন সেখানকার প্রশাসন জনপ্রতিনিধি বা রাজনীতিবিদ কারও মনেই রামু, নাসিরনগর বা সদরপুর দটনাসহ অন্য আরও ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো এলো না?
ধর্ম তো এতটাই ঠুনকো নয়, ফেসবুকে কে কী লিখল আর তাতেই ধর্মের অবমাননা হয়ে গেল। ধর্মের বিশ্বাসীদের তো বিশ্বাসই ধর্ম এসেছে ¯্রষ্টার কাছ থেকে। মুসলমানদের তো বিশ্বাসই ইসলাম হচ্ছে শান্তি প্রতিষ্ঠার ধর্ম যা স্বয়ং আল্লাহ্ মানুষের কল্যাণের জন্য পাঠিয়েছেন। তাই যে বিধান স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার নিজে দিয়েছেন তার সামান্য সৃষ্টির আচরণে কি কখনোই সেই বিধান হেয়প্রতিপন্ন হয়? ধর্ম হচ্ছে মানুষকে কল্যাণ, সত্য ও ন্যায়ের দিকে ডাকার একটি পথ। আর এটাই সত্য। এই সত্যকে যারা বিশ্বাস করেন তাদের পক্ষে কি সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা নিরীহ মানুষের বাড়ি-ঘরে হামলা করা আগুন দেওয়া, ধর্ষণ, লুট কিংবা সাধারণ মানুষকে হত্যা করা সম্ভব? আজ আমাদের সমাজ তথা রাষ্ট্রে একশ্রেণির মানুষ ধর্মকে ব্যবহার করছে নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থ রক্ষা এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখা বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে দখল করার হাতিয়ার হিসেবে। আর এতে তারা ব্যবহার করছে আমাদের সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষদের ধর্মীয় অনুভূতি, যা আমরা দেখেছি ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে।
হেফাজতে ইসলাম নামক তথাকথিত ধর্মীয় সংগঠনটি সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে সমগ্র দেশে কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিই না তৈরি করেছিল। ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে জামায়াত-শিবিরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের চেষ্টাও আমরা কম দেখিনি।
বিভিন্ন অযুহাতে একশ্রেণির কায়েমি স্বার্থপররা ধর্মকে ব্যবহার করে আমাদের দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের জানমালের উপর নানাভাবে হামলা করছে। সমাজ তথা রাষ্ট্রে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে, যা কোনো সভ্য সমাজের বাসিন্দাদের কাম্য নয়। তাই আমরা চাই, আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির বাংলাদেশে যারাই ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে রাষ্ট্র তাদের কঠোর হস্তে দমন করবে।
লেখক : কলামিস্ট
সম্পাদনা : আশিক রহমান ও খন্দকার আলমগীর হোসাইন