লাথির বিকল্পে লেখা এবং আমরা কেন লিখি
কে ন লিখি? এমন প্রশ্নটা শুনছি শুরু থেকেই। কলেজে উঠেছি, কবিতা লিখি, মাঝে মধ্যে প্রবন্ধও। বাবা এবং মা বাদে জ্ঞাতিদের অভিযোগ উচ্ছন্নে গেল। তারপর গানের দলের বাজিয়ে, উচ্ছন্নে যাবার আর কী বাকি থাকে। সুতরাং সে সময়ের ‘কেন লিখি’ এবং ‘উচ্ছন্নে যাওয়া’ -এর নাকবাঁকা প্রশ্ন খুব একটা গায়ে লাগে নি। কিন্তু মধ্যবয়স পাড়ির পথে ‘কেন লিখি’ এমন প্রশ্নে স্বভাবতই বিরক্তি লাগে। প্রথম বয়সের ‘কেন লিখি’ -এর সাথে লাভ-লোকসান যোগ হয় নি, কিন্তু মধ্যবয়স শেষে এখন সবকিছুর সাথে যোগ হয়েছে হিসেবের নিকেশ টুকু। ‘কেন লিখি’ -এর সাথে যোগ হয়েছে ‘কী লাভ’ এমন প্রশ্নও।
অনেক বড় বড় লিখিয়ে বলেন, তাদের লেখা সংস্কারের জন্য, বিপ্লবের জন্য এবং তারা এসবের প্রতি কমিটেড বলেই লিখেন। স্রেফ মিথ্যা কথা। একজন প্রকৃত লিখিয়ের লেখা শুরু হয় কোনো চিন্তা ছাড়াই। লেখার বীজ থাকে রক্তের ভেতর, অসঙ্গতি দেখলেই তাড়া করে। সেই তাড়াতেই লিখতে বসা। সেই লেখা কোথাও ছাপা বা প্রকাশিত হবে, মানুষ পড়বে, সমাজের আমূল সংস্কার ঘটবে এমন ধারণা প্রকৃত লেখকের মাথায় থাকে না, মাথায় থাকে শুধু একটাই তাড়ণা, লিখতে হবে। লেখাটা শেষ হলে সেই তাড়ণা থেকে তিনি মুক্তি পান, স্বস্তি পান। প্রাপ্তবয়স্ক উদাহরণে সেই স্বস্তি অনেকটা ‘অর্গাজমে’ -এর মতন।
জানি অনেকে বলবেন, বাজে কথা এবং সাথে বিরক্তও হবেন। হোন এবং বলুন, তাতে আপত্তি নেই। এক সময় প্রতিটি লিখিয়ের লেখার খাতায় উঁকি দেওয়া সম্ভব ছিল না। প্রযুক্তি সেই বাধা কিছুটা হলেও দূর করেছে। এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উঁকি দিলেই অনেক লিখিয়ের খোঁজ পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে কারো কারো লেখার তথ্য, যুক্তি এবং বিশ্লেষণের গতিময়তা অনেক উড়তে থাকা ‘বড় লিখিয়ে’দের মাটিতে শুইয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এসব লিখিয়েরা কিন্তু লেখার তাড়ণাতেই লিখেন, অন্যকিছুর জন্য নয়।
যাহোক, ‘কেন লিখি’ এবং ‘কী লাভ’ এমন প্রশ্নের উত্তর তো এক প্রকার দেওয়াই হয়েছে। কিন্তু তাতেও কী পরিত্রাণ মিলে। এখন এ দুটির সাথে যোগ হয়েছে ‘কোথায় লিখি’ এমন প্রশ্নের। কদিন আগে ‘দৈনিক আমাদের অর্থনীতি’র শেষ পাতায় আমার একটি ‘কলাম’ প্রকাশিত হয়েছিল। এক ‘শুভাকাঙ্খি’র চোখে পড়েছিল লেখাটি। সেই ‘পড়া’টাকে সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্য কোনটা বলব তা নিয়ে সংশয়ে পড়ে ছিলাম তার ‘কোথায় লিখি’র প্রশ্নে।
‘ভালোই তো লেখেন। তবে এসব অর্থনীতি-ফিতিতে না লেখে বড় কোনো পত্রিকায় লেখতে পারেন না।’ ভদ্রলোক বয়োজ্যেষ্ঠ, তারপরও নিজ ভাষায় বড় পত্রিকার লিখিয়ে সুতরাং এমন বেমক্কা প্রশ্নে ঘাবড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। ঘাবড়ে গিয়েই উত্তর দিলাম, ‘ভাই আপনি যে কাগজে লিখেন, সেখানকার নির্ধারণী নীতির সাথে ‘বেমিল’ হওয়াতে চাওয়া সত্বেও লেখা দেওয়া হয়ে উঠেনি।’
বললাম, আমি সেখানেই লিখি, যেখানে লিখতে স্বাছন্দ্য বোধ করি। ‘আমাদের অর্থনীতি’তে সে কারণেই লিখা। কাগজটির সম্পাদক কখনো বলেননি, আপনার এই লেখাটির অমুক লাইনকটি বাদ দিতে হবে, এটা আমাদের কাগজের সাথে যায় না। হয়তো বলার প্রয়োজন বোধ করেননি। এছাড়াও কোনো কাগজে লেখা ছাপার সাথে সম্মানী পাবারও একটা ব্যাপার রয়েছে। জাহাঙ্গীর নগরের বাংলার শিক্ষক, কবি ও গবেষক অনুজ সুমন সাজ্জাদ বলেন, ‘লেখার সম্মানী পাবার ব্যাপারটিই আলাদা, সেটা পাঁচ সিকা হলেও’। আমি নিজেও মানি কথাটি। দৈনিক অর্থনীতির ‘কলাম’ বিষয়ক বিভাগটির আশিক রহমান শুধু ‘এডিটে’র কাজই করেন না, সম্মানীর ব্যাপারটিও দেখেন। যখন ফোন করে বলেন, ‘ভাই, টাকা-পয়সা লাগবে না’, বড় ভালো লাগে। তার এ নিষ্ঠাটি অসাধারণ। লেখাটির এ অংশ মূলত লেখার স্বাধীন তার সাথে সম্মানী দেওয়ার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্যই। তবে এর অন্যথা কখনো যদি হয়, তবে তখনের পথ আলাদা। ফুট নোট : আমি জানি সার্বিক ‘কেন লিখি’র পরিপূর্ণতা এলে ক্ষতি নেই। নেই কারণ ‘কেন লিখি’র মূল কথাটা বলে গেছেন স্বয়ং কবি রফিক আজাদ। বলে গেছেন, নির্বিবেক মধ্যবিত্ত পাঠকের পরস্পরাময় মাংসল পাছায় খুব কষে লাথি মারা সম্ভব হয় না বলে, লাথির বিকল্পে লেখা। এত অল্প কথায় ‘কেন লিখি’র সার্বিক বয়ান আমার পক্ষে সম্ভব নয় বলেই লিখিনি, রফিক আজাদ লিখেছেন বলেই লিখিনি। রফিক আজাদ ‘লাথির বিকল্প লেখা’ লিখেছেন, আমরা লেখার বিকল্পে শব্দের ত্যানা পেঁচাই, আর সেই পেঁচানো ত্যানাতে ক্রমাগত ব্যর্থতায় ‘আতঙ্কিত ও লজ্জিত’ মুখ ঢাকি।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা : আশিক রহমান ও মোহাম্মদ আবদুল অদুদ