মানব সম্পর্ক, মানসিক কাঠামো এবং এর কার্যক্রম
শাহিনুর আক্তার
মানব সম্পর্ক, মানুষের মানসিক কাঠামো এবং এর কার্যক্রম এক জটিল বস্তু, নিঃসন্দেহে। বিশেষ করে, এই কর্মকা- যখন বিকার পর্যায়ে বা অস্বাভাবিক পর্যায়ে চলে যায়, তা থেকে ব্যক্তিকে এবং তার পারিপার্শি¦ক অবস্থাকে স্বাভাবিক পর্যায়ে আনার জন্যই বিভিন্ন চিন্তাবিদ বা তাত্ত্বিকগণ এর উৎস বা কারণ বোঝার চেষ্টা করেছেন। এই পর্যন্ত যত ধরনের তত্ত্বের উদ্ভব হয়েছে, গুণগতমান বা বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী আমরা এদেরকে প্রধান দুটো শ্রেণিতে বিভক্ত করতে পারি। একটি হলো মেডিকেল মডেল (সবফরপধষ সড়ফবষ) এবং অন্যটি হলো মনোস্তাত্ত্বিক মডেল (ঢ়ংুপযড়ধহধষুঃরপধষ সড়ফবষ)। আমরা সবাই জিগমুন্ড ফ্রয়েডের অবদানের কথা জানি, কিন্তু আমাদের মধ্যে খুব কম মানুষই ফরাসি মনোস্তাত্ত্বিক এবং দার্শনিক জাঁক লাঁক (ঔধপয়ঁবং খধপধহ) এবং তার কাজের সাথে পরিচিত। ফ্রয়েডের অনেক তত্ত্বই পরবর্তীকালের জাঁক লাঁক (ঔধপয়ঁবং খধপধহ) এর কল্যানে পরিপূর্ণতা এবং স্পষ্টতা পায়। তিনি ফ্রয়েডের প্রস্তাব, অনুমান (চড়ংঃঁষধঃরড়হ, চৎড়ঢ়ড়ংরঃরড়হ) কে নিজ অবস্থান হতে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন, যা মনোস্তত্ত্বকে নতুন এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়ে ভিন্ন এক মাত্রা দিয়েছে।
জিগমুন্ড ফ্রয়েড মানুষের মনের কার্যক্রমের ধরন এবং গতিবিধির প্রকৃতি অনুযায়ী প্রধান তিনটি কাঠামোতে বিভক্ত করেছেন। সেগুলো হলো নিউরোটিক, সাইকোটিক এবং পারর্ভাট। জিগমুন্ড ফ্রয়েড দেখিয়েছেন যে, মানসিক কাঠামোগুলো অনেকটা কিউবের মতো। আমরা যদি কোনো একটি কিউবকে ছোট ছোট টুকরা করি তবে সেখান হতে আরও কিছু কিউব পাব, এক্ষেত্রে প্রতিটি কিউবের গুণগতমান বা প্রকৃতি একই থাকবে। আমাদের জীবনে যা কিছুই ঘটুক না কেন, আমরা আমাদের মূল ক্রিয়াশীল কাঠামোর মধ্য থেকেই আমাদের আশেপাশের ঘটনাগুলোর প্রতি প্রতিক্রিয়া করে থাকি। আমাদের মানসিক জগত অজ্ঞান বা অচেতন (ঁহপড়হংপরড়ঁং) দ্বারা বিন্যাস্ত বা নিয়ন্ত্রিত। অজ্ঞান বা অচেতন গড়ন ভাষার সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। শেষ পর্যন্ত ভাষাই হলো আমাদের মনের কাঠামোর প্রধান ভিত্তি। ভাষার মধ্য দিয়ে আমরা সাংকেতিক বা প্রতীকী জগতে প্রবেশ করতে পারি।
মানুষের মানসিক কাঠামোই নির্ধারণ করে দেয় আমরা কিভাবে এই প্রতীকী জগত বা পৃথিবীর সাথে সম্পর্কিত হবো। প্রতিটি কাঠামোর নিজস্ব ধরন এবং বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বাহ্যিক জগতের সাথে সম্পর্কিত হবার ক্ষেত্রে, অন্যদের সাথে সম্পর্ক তৈরি এবং চর্চার ক্ষেত্রে প্রতিটি গঠন বৈশিষ্ট্যই আলাদা, ভিন্ন তাদের নিয়মকানুন আর ভাষা। উদাহরণস্বরূপ : নিউরোটিক এবং সাইকোটিক, দুটো কাঠামোর ভাষা এবং কার্যক্রমের ধরন ভিন্ন। যেন একজনের ভাষা জাপানিজ হলে অন্যজনের ভাষা রাশান। একজন অপরজনের ভাষার সামান্যটুকুও আয়ত্ব করতে পারে না। মানসিক কাঠামোগত ভিন্নতার কারণেই প্রধানত আমাদের সম্পর্কগুলো এতটা জটিল এবং অবোধ্য হয়ে থাকে। কাঠামো তিনটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো :
(ক) নিউরোটিক : অবদমন (জবঢ়ৎবংংরড়হ) হলো প্রধান প্রতিরক্ষা কবজ (উবভবহপব সবপযধহরংস)। বাহ্যিক জগত হলো অতৃপ্তি বা অস্থিরতার মূল উৎস। সাধারণত বাহ্যিক জগত ক্রমাগতভাবে ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ মানসিক জগতকে অস্থির করে তোলে। ব্যক্তি সেখান হতে পরিত্রাণ বা মুক্তি পাবার চেষ্টা করে, দুটো জগতের সাথে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করে। অবদমন (জবঢ়ৎবংংরড়হ) এক্ষেত্রে প্রধান সহায়।
(খ) সাইকোটিক : এর মূল বৈশিষ্ট্য হলো খোঁজাকরণ উদ্বেগ বা ঈধংঃৎধঃরড়হ অহীরবঃু। ফ্রয়েডের মতানুযায়ী, সাইকোটিকরা এই খোঁজকরণ উদ্বেগকে চিহ্নিত করতে পারে না বা বুঝতেও পারে না। কিন্তু, অচেতনভাবেই তারা এক ধরণের প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে চলে যায়। লাঁক এক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা বা ফবভবহপব কে ঋড়ৎপষঁংরড়হ নামকরণ করেছেন, যেখানে প্রতীকীকরণ বিষয়টা অনুপস্থিত।
(গ) পারভার্সন : এর মূল বৈশিষ্ট্য হলো অস্বীকার (উবহরধষ)। খোঁজাকরণ উদ্বেগ (ঈধংঃৎধঃরড়হ অহীরবঃু) ব্যক্তি অস্বীকার করে। এটি সাইকোসিসের ঠিক বিপরীত। ব্যক্তি জানে তার এই উদ্বেগের বিষয়। কিন্তু নিজের সাথে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য এই অস্বীকার বা উবহরধষ এর আশ্রয়। এই অস্বীকার মূলত অবদবন (জবঢ়ৎবংংরড়হ) এর ব্যর্থতা। অস্বীকার ব্যক্তিকে অস্বস্তিকর বা অপ্রীতিকর বিষয় থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখতে সক্ষম হয়। পারভার্সনের ক্ষেত্রে ব্যক্তির সীমাহীন আনন্দলাভ অন্যের ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ কোনোরকম বিবেকের দংশন ছাড়াই ব্যক্তিকে (ংঁনলবপঃ) বস্তুতে (ড়নলবপঃ) পরিণত করার মধ্য দিয়েই তাদের মূল আনন্দ লাভ করে থাকে। লাঁকের মতে ‘তারা সুন্দর কথা বলে, সুন্দর চিন্তা করে, কিন্তু কাজটা করে জঘন্য।’ এই উক্তিই পারভার্সনের মূল বোঝার জন্য যথেষ্ঠ। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যৌনতার সাথে পারভার্সনকে সম্পৃক্ত করা হয়। তবে সবক্ষেত্রে সেটি সত্যি নাও হতে পারে। যেমন- পারভার্ট ব্যক্তি মাত্রই ধর্ষক, নির্যাতনকারী হবে তা নয়। রাস্তার লাল বাতি অমান্য করা বা অন্যের জিনিস ফেরত না দেওয়ার মধ্যেও পারর্ভাট প্রক্রিয়া কাজ করে। পারভার্সন মানেই জঘন্য কিছু তা নয়। এটি সমাজের বিধি-নিষেধ এবং নৈতিক অবস্থানের সাথে সম্পর্কিত। সেখানে অস¦ীকার এবং নিজস্ব নিয়ম প্রতিষ্ঠিত করা অন্যতম প্রধান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। এই হলো তিনটি মানসিক কাঠামোর মূল বৈশিষ্ট্য। লাঁকের মতে, মানবকূল যেকোনো তিনটি গড়নের একটির আওতায় পরতে বাধ্য। স্বাভাবিক গড়ন বা ঘড়ৎসধষ ংঃৎঁপঃঁৎব বলে কিছু নেই। ব্যক্তি হয় সাইকোটিক, না হয় নিউরোটিক, না হয় পারর্ভাট হবে, এটাই তার নিয়তি। এক্ষেত্রে প্রশ্নটা হলো মাত্রাগত, কাঠামোটি স্বাভাবিক মাত্রায় না অস্বাভাবিক মাত্রায় ব্যক্তির মধ্যে ক্রিয়াশীল সেটি মূখ্য। আর সেটিই স্বাভাবিকতার বা বিকারগ্রস্থতা অন্যতম মাপকাঠি।
লেখক : মনোবিদ
সম্পাদনা : আশিক রহমান