হত্যা ও নাশকতার পথে রাজনীতিতে সাফল্য সুদূর পরাহত
ড. মিল্টন বিশ্বাস
বিএনপি ও জামায়াত অনেক আগে থেকেই চিন্তাচেতনায় একই ধরনের। তাদের রাজনৈতিক কোনো আদর্শ নেই। মাথায় আছে মানুষ মারার ষড়যন্ত্র। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংসদের বাইরের বিরোধী দল হিসেবে তারা কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করেনি। বরং মহাজোট সরকারের আমলে সংসদ বর্জন করে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগকে উদ্দেশ্য করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের কিছুদিন আগে বলেছিলেন, ২০০৭ সালে আপনারা কেএম হাসানকে মেনে নেননি, তাই এখন দলীয়প্রধান শেখ হাসিনাকে আমরা মেনে নেব না। শেখ হাসিনার অধীনে কোনোভাবেই নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না। তাই তাকে পদত্যাগ করতেই হবে। তিনি আরও বলেছেন, নৌকার তলা এখন ফুটো হয়ে গেছে, তাই নৌকা ডুবে যাচ্ছে। এই ডুবন্ত নৌকায় এখন আর কেউ উঠবে না। সবাই ইঁদুরের মতো নৌকা থেকে লাফিয়ে বাঁচার চেষ্টা করবে। সারাদেশের মানুষের এখন একটাই দাবি আর তা হচ্ছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। তাই সকল রাজনৈতিক দলকে বলব, আসুন ঐক্যবদ্ধ হই। কে ছোট কে বড়, সেটা দেখার সময় এখন নেই। কে ডানে কে বামে তা দেখারও সময় নেই। আসুন আওয়ামী লীগকে বিদায় করে একসঙ্গে নির্বাচন করে সরকার গঠন করি। এখন একমাত্র কাজ এ সরকারকে হটিয়ে দেশ রক্ষা করা। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় গেলে আলোকিত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হবে। কাজেই দেশবাসীকে বলব ‘হঠাও আওয়ামী লীগ, বাঁচাও দেশ।’ বেগম জিয়া বিভিন্ন জনসভায় মানুষকে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে নিজের দলের ফায়দা লুটতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে সময় যেমন সর্ব ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছিলেন তেমনি বর্তমান সরকারের ধারাবাহিকতায় (৯ বছরে) নিরন্তর চেষ্টা করে সফল না হওয়ার সম্ভাবনা দেখে নাশকতার পথ বেছে নিয়েছিলেন কি?
বিএনপি নামক দলটির ভেতরে কোন্দল আর জামায়াত তথা মৌলবাদী দলগুলোর সঙ্গে দরকষাকষি আর কলহ আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভীষিকার জন্ম দিয়েছে। খালেদা জিয়ার বাড়ি ছাড়ার ইস্যু থেকে পরবর্তী প্রতিটি ইস্যুর হরতালই ব্যর্থ হিসেবে গণ্য হয়েছে। ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা দল ছেড়েছেন; অন্যান্য প্রভাবশালী নেতাদের মধ্যে রয়েছে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব। বিভিন্ন জেলায় খালেদা জিয়ার সমাবেশের মধ্যেই আমরা লক্ষ করেছি বিএনপির দলীয় কোন্দল। গত ১৮/৯/২০১৩ তারিখে একটি দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে, ‘দক্ষিণে বিএনপির মূলধারা ও সংস্কারপন্থী বিরোধ চরমে’। ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, ভোলার বিএনপির মতো আন্তঃকলহ রয়েছে অনেক জায়গায়। রাজপথে সরকার পতনের মতো আন্দোলনের সাংগঠনিক ক্ষমতা না থাকায় এবং আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা ভাল হওয়ায় বিএনপি জনগণের কোনো আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। ইতোপূর্বে একাধিকবার সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, ‘বিএনপি-জামাত চারদলীয় জোট সরকার সামাজিক দুর্বৃত্তায়নকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ায় অতীতে দেশ সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও লাগামহীন দুর্নীতির অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিল। সে সময় রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় উন্মত্ত জোটের মন্ত্রী ও দলীয় নেতাদের তা-বের কথা আমাদের সকলের মনে আছে।’ এজন্য রাজশাহীতে খালেদা জিয়া যে বলেছিলেন, বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় গেলে আলোকিত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হবে।’ একথায় জনগণের কেউ বিশ্বাস করবে না। জামায়াত-বিএনপি জোটের ২০০১ সালের তা-বের আলামত মহাজোট সরকারের আমলেও দেখা গেছে। জামায়াত-শিবির কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে নাশকতার মধ্য দিয়ে হরতাল পালন করেছিল। আগের মতোই পুলিশের ওপর নির্বিচারে হামলা চালিয়েছে, হত্যা করেছে নিরীহ মানুষকে। তাদের নেতাদের মামলার রায়কে কেন্দ্র করে এর আগে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা এবং অগ্নিসংযোগ এবং অন্যান্য সন্ত্রাসী ঘটনা আমরা লক্ষ করেছি। বিভিন্ন হিন্দু বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও তা-বের ঘটনায় ছিল জামায়াতের প্রত্যক্ষ ইন্ধন ও সংযোগ। ধর্মীয় মৌলবাদীরা সুযোগের সন্ধানে রয়েছে। তারই স্পষ্ট আলামত দেখা গেছে অনেক স্থানের ঘটনায়। অন্যদিকে নিষিদ্ধ ঘোষিত ধর্মভিত্তিক গোপন সংগঠনের কার্যক্রম যে থেমে নেই তারও দৃষ্টান্ত পাওয়া যাচ্ছে জঙ্গি মর্থকদের ধ্বংসাত্মক কর্মকা- দেখে। প্রতি সপ্তাহে আতঙ্ক সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে। বিএনপি-জামায়াতের সহিংসতা থেকে মুক্তির উপায় তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে বর্জন করা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগের পতাকাতলে সমবেত হওয়া।
মূলত গত ৯ বছরে বিএনপি’ নেতৃত্বে নাশকতা ও হত্যাকা- ঘটিয়ে দেশের আপামর জনসাধারণের মধ্যে অনিশ্চয়তা ও উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করা হয়েছে। এজন্য রাজনীতিতে সুস্থ ধারার প্রচলন জরুরি হয়ে পড়েছে। আসলে শাসন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। রাজনৈতিক দলের সাফল্য নির্ভর করে শক্তিশালী নেতৃত্বের ওপর। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর সংজ্ঞার্থ অনুসারে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সংঘাতপূর্ণ প্রেক্ষাপটে নেতা ও অনুসারীগণ কর্তৃক স্বাধীনভাবে অথবা সমঝোতাপূর্ণভাবে স্থিরকৃত কিছু নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও মূল্যবোধ, বিভিন্ন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং অন্যান্য সম্পদরাজি ব্যক্তির দ্বারা সহজলভ্য করার পরস্পর বিনিময়কৃত প্রক্রিয়াই হলো নেতৃত্ব। এই সংজ্ঞায় রাজনীতি ও উন্নয়নের ধারণা বিজড়িত। জনগণের মৌলিক চাহিদা ও প্রয়োজনসমূহ একটি ভিশনের মাধ্যমে উচ্চতর চাহিদা ও প্রয়োজনে রূপান্তরিত করা নেতৃত্বের মূল লক্ষণ। জনগণের কাছে নেতৃত্বের একটি ভিন্নতর আবেদন থাকে যা কোনো ব্যক্তির গুণাবলির প্রতি জনগণের মধ্যে আকর্ষণ ও সক্রিয়তা সৃষ্টি করে। নেতা নির্দিষ্ট গুণাবলির দ্বারা সাধারণ মানুষ থেকে আলাদা। তার রয়েছে সুনির্দিষ্টভাবে ব্যতিক্রমী ক্ষমতা যা সাধারণ ব্যক্তির মধ্যে অনুপস্থিত। এজন্য তিনি নেতা হিসেবে গণ্য হয়ে থাকেন। বিএনপি-জামায়াতের নেতারা প্রকৃতপক্ষে আলাদা, ভিন্ন, স্বতন্ত্র ও নেতৃত্বের গৌরবজনক আসনে সমাসীন নন। তারা জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে ভূমিকা রাখেননি। জনতার আকাক্সক্ষাসমূহ এবং টিকে থাকার বাস্তবতার মধ্যে সেতু বন্ধনের সাহায্যে রাজনীতিতে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। এজন্যই গত ৯ বছরের রাজনীতিতে তারা হত্যা ও নাশকতার পথ বেছে নিয়েছেন। কিন্তু সে পথে রাজনীতিতে সাফল্য এখন সুদূর পরাহত।
লেখক : অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা : আশিক রহমান ও মোহাম্মদ আবদুল অদুদ