রোহিঙ্গা মুসলমান ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি
প্রত্যেকটি আন্তর্জাতিক ফোরামে রোহিঙ্গাদেরকে নিয়ে আলোচনা অব্যাহত থাকলেও কোনো এক রহস্যজনক কারণে মিয়ানমারকে কঠোর বার্তা দিতে অনেক দেশের অনাগ্রহ রয়েছে। বাংলাদেশের চেয়ে চারগুণ বড় মিয়ানমার, অথচ লোকসংখ্যা মাত্র ৫ কোটি। খাদ্য উৎপাদনের দৃষ্টিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। পৃথিবীর একাধিক দেশে খাদ্যশস্য রপ্তানির সাথে সাথে বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে উত্তোলনকৃত সম্পদ বিদেশে রপ্তানি করছে। যার নিয়ন্ত্রণটা করছে মিয়ানমারের সেনা কর্মকর্তারা। কাগজপত্রে গণতন্ত্র মিয়ানমারে থাকলেও দেশটি মূলতঃ সেনাবাহিনীর ইচ্ছা অনুযায়ী পরিচালিত হয়। এই মিয়ানমারে ১৪৫টি আদিবাসী গোষ্ঠী রয়েছে। গোষ্ঠীগত দ্বন্ধ মিয়ানমারকে অনেকটাই পিছিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। যাদেরকে মিয়ানমার সরকার, উগ্র বৌদ্ধ ভিক্ষু ও সেনাবাহিনী বাঙালি বলেন, তাদেরকে রোহিঙ্গা বলতে তারা রাজি নন। কিন্তু মিয়ানমারের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ৬০০ বছর থেকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব ছিল। এক সময় আরাকান প্রদেশটি একটি স্বাধীন দেশ ছিল। সেখানে মুসলমানদের রাজত্ব ছিল। অন্য ধর্মে বিশ্বাসীরা শান্তিতে সেখানে বসবাস করতেন। ব্রিটিশ শাসনের সময় যখন দেশটির নাম ছিল বার্মা, তখন আরাকান প্রদেশকে দখল করে নেওয়া হয়। হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যা করা হয়, ধর্ষণ করা হয়, দেশ ছাড়া করা হয়। তখন রোহিঙ্গারা কেউ পাকিস্তানে, ভারতে, বাংলাদেশে, মালয়েশিয়ায় ও থাইল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়েন। চিরদিনের জন্য দেশহারা হয়ে পড়েন। পৃথিবীতে আছে একমাত্র রোহিঙ্গা জাতি, যাদের কোনো দেশ নেই এটাই মিয়ানমার সরকার প্রমাণ করতে চাচ্ছেন। বাস্তবতা হচ্ছে, তারা মিয়ানমারের বৈধ নাগরিক। রাখাইন প্রদেশে কৃষি পণ্য উৎপাদনের পুরো কৃতিত্ব রোহিঙ্গা মুসলমানদের। কিন্তু তাদের নাগরিকত্ব নেই, নাগরিক অধিকার নেই, শিক্ষার অধিকার নেই, এক প্রদেশ থেকে আর এক প্রদেশে যাওয়ার অনুমোদন নেই, বিনা অনুমতিতে বিয়ে করার অনুমতি নেই, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান করার অনুমতি নেই। তাহলে আছে কি? বনের পশুকে যে অধিকারটুকু দেওয়া হয়, মিয়ানমার সরকার, সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ ভিক্ষুরা রোহিঙ্গা মুসলমানদের সেই অধিকারটুকু দিতে রাজি নন। যে কারণে তারা যেখানে পারছেন সেখানেই চলে যাচ্ছেন। কোথাও মিয়ানমারের সেনা সদস্য ও বৌদ্ধদের দ্বারা ধর্ষিত হচ্ছেন, সর্বহারা হচ্ছেন, তারপরও বিশ্ব বিবেক নিরব। এর মূল কারণ মিয়ানমারের ভৌগলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক সম্পদ। দীর্ঘদিন মিয়ানমারে সামরিক শাসন চলাকালীন শিল্প উন্নত দেশগুলো মিয়ানমারে প্রবেশ করতে পারেনি। একমাত্র চীন ছাড়া অন্য কোনো দেশ মিয়ানমারের কাছে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করত না। কিন্তু মিয়ানমারের কাগজি গণতন্ত্র চালু হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জাপান, ভারত, ইসরাইল, পাকিস্তান ও মিয়ানমারে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি শুরু করে। এককভাবে চীন মিয়ানমারে আর সুবিধা করতে পারছে না। এই সুযোগটা উল্লেখিত দেশগুলো নিয়ে নিয়েছে। ইতোমধ্যে চীন রাখাইন প্রদেশে এক হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করছে। রাখাইন প্রদেশ থেকে চীন পর্যন্ত একটি সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা চীন বাস্তবায়ন করছে। সেখানে একাধিক শিল্প কারখানা ছাড়াও সামরিক ঘাটি গড়ার পরিকল্পনা চীন করেছে। ইতোমধ্যে ইসরাইল মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেছে। দুটি যুদ্ধ জাহাজ সম্প্রতি বিক্রি করেছে। আরও দুটি নির্মাণ করে দিচ্ছে। অত্যাধুনিক সাব মেশিনগান মিয়ানমার সেনাবাহিনীতে ইসরাইল দিচ্ছে। এছাড়া অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির পরিকল্পনা করছে। রাশিয়া ২০টি মিগ-২৯ জঙ্গি বিমান বিক্রি করেছে। এছাড়া আরও বিভিন্ন শ্রেণির জঙ্গি বিমান বিক্রির পরিকল্পনা নিয়েছে। যেমন, মিগ-৩৫, ইয়াক-১৩০। এছাড়াও সামরিক হেলিকপ্টার ও জঙ্গি হেলিকপ্টার মিয়ানমারের কাছে বিক্রি করেছে। রাজধানী ইয়াংগুনে রাশিয়া একটি সামরিক অফিস খুলেছে। ভারত ও জাপান শত শত কোটি ডলার মিয়ানমারে বিনিয়োগ করেছে। মিয়ানমারের কাছে পাকিস্তান জঙ্গি বিমান বিক্রি করেছে। যে কারণে কোনো দেশ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কঠোর হতে রাজি হচ্ছে না। যে টুকু কথা যুক্তরাষ্ট্র বলছে সেটাও রাজনৈতিক কথা। যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে মিয়ানমারে বিনিয়োগ করতে। এই সুযোগটা যুক্তরাষ্ট্র যখন পেয়ে যাবে তখন নিরব হয়ে যাবে। এই সংকটময় মুহূর্তে আমাদের উচিত ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মুসলিম বিশ্বকে বিষয়টি ভাল ভাবে জানানো। তা না হলে এই সমস্যা কখনোই সমাধানের মুখ দেখবে না। রোহিঙ্গারা যে নিজেদের দেশে ফিরে যাবেন সেই সম্ভাবনাও শেষ হয়ে যাচ্ছে। যা করার অতিদ্রুত করতে হবে।
লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক
সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ