রোহিঙ্গা সমস্যায় কী করবে বাংলাদেশ?
বাংলাদেশকে যথেষ্ট সতর্কতার সাথে এগিয়ে যেতে হবে। উস্কানি দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন কর্ণার থেকে। দেশের ভেতরে তো উস্কানি দেওয়ার পার্টি আছেই, বাইরেও রয়েছে অনেক গোষ্ঠী। তারা সব সময়ই চাইবে মিয়ানমারের সঙ্গে লাগুক বাংলাদেশ। লাগলে কী হবে? তারা তখন বগলে ডুগডুগি বাজাবে মহানন্দে। তারা তো চাইছেই দেশের ভেতরে আর বাইরে লাগুক বিশৃঙ্খলা। এ সুযোগে ঝেঁকে বসবে বাংলাদেশের ঘাড়ে আর স্ট্র্যাটেজিক অবস্থানে থাকা বাংলাদেশের বুকের মধ্যিখানে আরাম কেদারা নিয়ে বসে যাবে সাহায্য দেওয়ার নাম করে। হাতিয়ে নেবে বঙ্গোপসাগরের সম্পদ, হাত দিবে সার্বভৌমত্বে, মাতব্বরি করার সুযোগ খুঁজবে নানা উছিলায়। অর্থনৈতিক অগ্রগতির বর্তমানের বেগবান ধারাকে তছনছ করে দিবে। ঠেলে দিবে বাংলাদেশকে অনেক পেছনে।
তবে এসব দেশ একটি ক্ষেত্রে কৃপণতা করবে না। ত্রাণ দিয়ে যাবে অঢেল। অর্থ ঢালবে বেশুমার। উখিয়া-কুতুপালং আর আশপাশের এলাকায় বানাবে রোহিঙ্গাদের জন্য বাসস্থান। সাথে থাকবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, বিনোদন কেন্দ্র, শিশুপল্লী এবং বসবাসের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু। করে দিবে তারাই রোহিঙ্গাদের দিকে মায়া-মায়া চোখে তাকিয়ে, হাসিমাখা বদনে। কত দরদ ফুঁটে উঠবে দুই নয়নে। কিন্তু তৃতীয় নয়নটি থাকবে পুঁজিবাদী স্বার্থের ধবল অশ্বের দিকে। আর যথাসময়ে দশ-এগারো লক্ষ রোহিঙ্গা চিরকাল ধরে ভাগ বসাবে ১৬ কোটি বাংলাদেশির ভাত-পাতে। এক সময়ে চলে যাবে মূল ধারায়। কক্সবাজার-বান্দরবানের অধিবাসীরা মাইনরিটি হয়ে পড়ে থাকবে নিঝুম বনে। এ দিকে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বাজারও গরম হচ্ছে এ উপলক্ষে। পেঁয়াজের ঝাঁঝ লেগেছে রাজনীতিতে। তবে এ পেঁয়াজ সে পেঁয়াজ নয়। এ হলো দেশের ভালো না চাওয়া লোকদের পেঁয়াজ। ২৯ অক্টোবর রোববার একটি পেঁয়াজের দাম ছিল নাকি ৫ টাকা। এ দিনই হঠাৎ চাঙগা হয়ে ওঠা নেতা-নেত্রীরা ছুটে চলেছিলেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দিকে সাথে বিশাল শো-বাহিনী নিয়ে। সাথে কি ছিল কাঁচা মরিচের ঝাল? অগণিত গাড়ির বহর নিয়ে তাদের রোহিঙ্গা-দর্শণ কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে? কাঁচা মরিচের ঝাল আর ঁেপয়াজের ঝাঁঝ, এ দুয়ে মিলে হবেটা কী! আবার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরেও ইতোমধ্যে ঘটেছে মারপিট এমনকি হত্যার ঘটনা। শোনা যাচ্ছে কিছু রোহিঙ্গা যুবকের হাতে চলে গিয়েছে আধুনিক অস্ত্র। হাওয়া গরম করা হচ্ছে না-তো?
প্রভাব পড়েছে এবং পড়বে অনেক কিছুতে। আজ পর্যন্ত রোহিঙ্গায় ধ্বংস ১৬০০ একর সামাজিক বনায়ন। ইতোমধ্যেই ক্ষতি হয়েছে ১৫০ কোটি টাকা। প্রতিদিন ওরা উখিয়া টেকনাফে আরও বনাঞ্চল দখল করে নিচ্ছে। বন এক বার ধ্বংস হলে আবার গজিয়ে উঠে না। মারাত্মক পরিবেশ বিপযর্য়ের আশঙ্কা। পাহাড় ধ্বসের ঝুঁকি তো রয়েছেই। সরকারও উখিয়ার বালুখালি এলাকার তিন হাজার একর জমি রোহিঙ্গাদের আবাসের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এর বাইরেও তারা বিপুল পরিমাণ পাহাড় ও বনভূমি দখল করে নিয়ে বসবাস করা শুরু করেছে। যার পরিমাণ ৫ হাজার একর হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। ওই এলাকার পর্যটনে শুরু হয়েছে ভাটার টান। অর্থনীতিতে ধাক্কা শুরু হয়েই গিয়েছে। পর্যটন মৌসুমের শুরুতেই প্রথম ধাক্কা লেগেছে সেন্ট মার্টিন ভ্রমণে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ভ্রমণ বন্ধ সাগর পথে নিরাপত্তা বিঘিœত হওয়ার আশঙ্কায়। কক্সবাজারেও পর্যটক আসছে না তেমন। বান্দরবানের পর্যটন তো সেপ্টেম্বরেই গোত্তা খেয়ে বসে গেছে। বর্ডার ট্যুরিজএর নাভিশ্বাস শুরু। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামেও রোহিঙ্গা-প্রভাব। সক্রিয় হচ্ছে মানব পাচারকারীরা। রোহিঙ্গারা সুন্দর জীবনের হাতছানির মায়াজালে বন্দি হয়ে খপ্পরে পড়তে পারে জঙ্গীগোষ্ঠীর। রোহিঙ্গাদের সস্তা শ্রমের কারণে এদেশীয় শ্রমিকদের শ্রমবাজারে পড়তে পারে বিরূপ প্রভাব। ছিনতাই রাহাজানি সহ অসামাজিক কার্যকলাপ বাড়তে পারে। পাহাড়ি এলাকায় আগে থেকে সক্রিয় চরমপন্থীরা সুযোগ কাজে লাগানোর অপতৎপরতায় নেমে পড়তে পারে।
সবকিছু মাথায় রেখে বাংলাদেশকে কৌশলী হতে হবে। কয়েকগুণ বেশি জোরদার করতে হবে কূটনৈতিক তৎপরতা। চেষ্টা করতে হবে ভারত-রাশিয়াসহ সব শক্তিশালী দেশগুলোকে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে বহুমাত্রিক ও বহুপাক্ষিক (অবশ্যই দ্বিপাক্ষিক নয়) দর-কষাকষির মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো অনতিবিলম্বে। যতবেশি বিলম্ব হবে, মিয়ানমার তার অবস্থান ততবেশি শক্তিশালী করে নিতে তৎপর থাকবে। একই সাথে গ্রহণ করতে হবে এমন ধরনের মাস্টার প্ল্যান যার বাস্তবায়নের কারণে আশ্রিত রোহিঙ্গারা যতদিন থাকবে তত দিন আয়-বর্ধনমূলক কাজ করে সংসার চালাতে পারবে; নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে যেতে দেওয়া যাবে না; এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট করতে পাবে না; সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর সাথে জড়াতে পারবে না; শ্রীলঙ্কার জাফনা অঞ্চলের তামিলদের মতো সংঘবদ্ধ হয়ে দেশবিরোধী অপতৎপরতায় লিপ্ত হতে পারবে না কিংবা মেইনল্যান্ডের অধিবাসীদের সাথে মিলেমিশে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে মূলধারার সাথে মিশে যেতে পারবে না। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিও পরিকল্পনায় থাকবে। জাতিগতভাবে রোহিঙ্গারা জন্ম নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে খুবই অসচেতন। তাদেরকে জন্মনিয়ন্ত্রণে উদ্বুদ্ধ করা না গেলে কয়েক বছরের মধ্যেই রোহিঙ্গা জনসংখ্যায় বিস্ফোরণ ঘটবে যা অনেক সামাজিক-অর্থনৈতিক, এমনকি রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করবে।
কোনোমতেই ভুলে যাওয়া যাবে না যে, বাংলাদেশে এখন তিন কোটির বেশি লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে। একবারেই হতদরিদ্র। এদের দিক থেকে দৃষ্টি যেন অন্য দিকে সরে না যায়। বাড়তি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যেন এদের ভাতের থালায় ভাগ না বসায়। হর বছর বন্যা, জলোচ্ছ্বাস বা ঝড়-তুফানে বিধ্বস্ত মানুষ তো আছেই এ বাংলাদেশে। এদেরকেও দেখতে হয় সরকারকেই। কাজেই রোহিঙ্গা ইস্যু শুধু রোহিঙ্গাতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। এর ব্যাপকতা অনেক বিশাল। তবে সমস্যা যেহেতু আছে, সমস্যার সমাধানও আছে। সমাধান ছাড়া কখনো সমস্যার সৃষ্টি হয় না। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সমস্যার মখোমুখি করার আগেই সমাধান তৈরি করে রাখেন। আমাদের কাজ হবে কৌশলিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে সমাধানের সন্ধান করা। সমাধানের সন্ধান মিলবেই। আজ কিংবা কাল। আমরা হতাশ হবো না। হতাশা হোক ইবলিসের পোশাক।
লেখক : কলামিস্ট ও শিক্ষাবিদ; উপাচার্য, বাংলাদেশ উ›মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়