এরিয়া ক্লিন অপারেশন দেখে গেলেন অং সান সুচি
অধ্যাপক মো. আনিসুর রহমান ফরাজী
২ নভেম্বর মিয়ানমারের রাখাইন আরাকান রাজ্য সফরে এলেন অং সান সুচি। রাজকীয় আভিজাত্য সমৃদ্ধ হাস্যজ্জ্বল বদনে নেমে এলেন বিশেষ নিরাপত্তা বলয়ের মধ্য দিয়ে আরাকান রাজ্যে সামরিক হেলিকপ্টার যোগে আসেন তিনি। হাস্যজ্জ্বল নয়নে চেয়ে চেয়ে দেখলেন সফল এরিয়া ক্লিন অপারেশন। ছোট করে বললেন ‘তোমরা আর ঝগড়া করো না’! এ কিসের প্রতিফলন? লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাদের ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে, আবাল-বৃদ্ধবণিতা রোহিঙ্গাদের নিধন করে, পাশবিক অত্যাচার করে মা-বোনদের ইজ্জত নষ্ট করে সফল এরিয়া ক্লিন অপারেশন দেখে উৎফুল্ল চিত্তে রোহিঙ্গাদের উদ্দেশ্যে বলে গেলেন ‘তোমরা আর ঝগড়া করো না’। কিন্তু কোনো সমাধান তো এলো না। তা হলে কি হবে রোহিঙ্গাদের?
বিশ্ববাসী আজ স্পষ্টতই বুঝতে পারছেন আরাকান রাজ্য’র এরিয়া ক্লিন অপারেশনের নেপথ্যে কি? বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র যার ঐতিহ্য, অভিজাত্য ও গর্বিত ইতিহাস রয়েছে। কোনো সামারিক জান্তার পৃষ্ট আরোহণ করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয় নি! হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এর বলিষ্ট নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে। পাকিস্তানের সামরিক জান্তাদের দমন পীড়নে বাঙালি জাতি হার মানে নি। বরং পাকিস্তানি সামরিক জান্তারাই তাদেরই ললাটে কলঙ্ক লেপন করে বাংলাদেশ থেকে চির বিদায় নিয়েছে। ৭ কোটি বাঙালির স্থলে আজ ১৭ কোটি বাঙালি। জাতির জনকের সুযোগ্য কন্যা জন নেত্রী শেখ হাসিনা আজ রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন। রক্তের প্রবাহে তিনিও কোনোদিন হার মানবেন না। গোটা বাঙালি জাতি কোনোদিন হার মানবে না। রোহিঙ্গাদের প্রতি আমরা মানবতার হাত বাড়িয়েছি। বিশ্ববাসী তা সমর্থন দিয়েছেন। প্রশংসা করেছেন বাংলাদেশের। মানবিক সহযোগীতা ও সহায়তা দিচ্ছেন। জাতিসংঘসহ বিশ্বের সচেতন মানব সভ্যতার কা-ারীগণ এগিয়ে আসছেন। বিশ্বের প্রচার মাধ্যমে সরাসরি প্রতিবেদন সম্প্রচার হচ্ছে রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ কি করছে। সরকারি বেসরকারি সকল সংস্থা রোহিঙ্গাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসা দিচ্ছেন। কিন্তু এদের নাগরিক অধিকার কে দিবে? অং সান সুচি যিনি বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানী খেতাব নোবেল বিজয়ী হয়েছেন কিসের মহিমায়? বিশ্বের সর্বপরিচিত একটি নাম শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সুচি। আরাকান রাজ্যে তার অগমন কি শান্তি বয়ে আনল? বিশ্ব দরবারে আজ তিনি কিভাবে উপস্থিত হলেন এই রাজকীয় হাস্যজ্জ্বল বদনে? বিশ্ববিবেক আজ প্রশ্ন রাখতে পারেন। তার এই সফর আজ শান্তির বার্তা বয়ে আনেনি। বয়ে এনেছে এরিয়া ক্লিন অপারেশনের নায়কদেরকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। তিনি তাদেরকে অভিনন্দন জানিয়ে বলে গেলেন ‘তোমরা আর ঝগড়া করো না’। লক্ষ লক্ষ মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা, মা-বোনদের উপর পাশবিক নির্যাতন, আরাকান রাজ্যের আধমরা অধিবাসীদের বাংলাদেশে পুশ ইন; এ কি একটি নিছক ঝগড়া?
একটি রাজ্যের পুরো জাতিকে নিধন করা সফল হয়েছে দেখে উৎফুল্ল বদন দেখানো একি মানবতার ক-ারীর মানবতার লক্ষণ? ক্ষমতার লোভ মানুষকে হিং¯্র পশু করে তোলে। আবার একদিন এই পশুগুলি সাধারণ মানুষের কাছেই হার মানে। মানুষই পশুকে বাঁচিয়ে রাখে। তবে এখানে রাজনীতি সমাজ চিন্তা, কূটনীতি সবই যেন হার মানছে। রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের বিপর্যয় আজ মানব সভ্যতার বিপর্যয়। এ বিপর্যয়ে কিছুতেই হার মানা যায় না।
যেখানে বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের ভাত কাপড় আছে সেখানে ১০-১২ লক্ষ অতিথির ভাত-কাপড় ও বাসস্থানের ব্যবস্থা না হয় হলো তবে এই সংকটের স্থায়ী সমাধান কি হবে? রোহিঙ্গাদের তাদের রাজ্য বিভিন্ন পরিসংখ্যানে প্রকাশিত হয়েছে, বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শিশুদের মাঝে ২৭ হাজার শিশু রয়েছে পরবর্তী হিসেবে এর সংখ্যা আরও বেড়ে যেতে পারে। এই অনাথ, পিতৃ-মাতৃহীন শিশুদের ভবিষ্যৎ কিভাবে গড়ে উঠবে? এছাড়াও স্বামী হারা মহিলা রয়েছে, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা রয়েছে। পুরো রোহিঙ্গা সমাজ আজ কর্মহীন অলস সময় কাটাচ্ছে। নিজ ভূমি ছেড়ে পরদেশে এরা কি করবে, যাদের সীমানার বাইরে আমার অনুমতি নেই, কর্মের সংস্থান নেই, শিক্ষার ব্যবস্থা নেই, নাগরিকত্ব নেই। পর্যায়ক্রমে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সমস্ত পরিকল্পনা, মায়ানমার সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, কূটনৈতিক সম্পর্ক, আলাপ-আলোচনা সবই ভেস্তে যাচ্ছে। সমস্ত বাঁধা অতিক্রম করে রোহিঙ্গা নারী পুরুষ সমবেত হচ্ছে আর দফায় দফায় বাংলাদেশে ঢুকছে। কবে হবে এর সমাপ্তি? রাজার, উখিয়া এবং এর পার্শবর্তী অঞ্চলে আজ ঠাঁই নেই, মানুষে মানুষে লোকারণ্য, বাড়ছে অনেক রোগব্যাধি, হাঁট-বাজারে দ্রব্যমূল্যের অপ্রতুলতা এবং বাড়তি দাম, শিক্ষার্থী যারা তারা স্কুল-কলেজে যেতে পারছে না, হাসপাতালগুলোতে মেঝে মাঝে স্থান সংকুলান, হচ্ছে না ঐ সমস্ত আরাকানবাসীর বাংলাদেশে অবস্থার কারণে। ধ্বংস হচ্ছে পাহাড়, গাছ ও বনভূমি। এসমস্ত মিলে রোহিঙ্গাদের নিয়ে এক চরম সংকটে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে শিগগিরই একটি স্থায়ী সমাধান একন্তই প্রয়োজন।
লেখক : অধ্যক্ষ, ইন্টারন্যাশনাল নার্সিং কলেজ,টঙ্গী, গাজীপুর
সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ