#Metoo
প্রিয়াংকা আচার্য্য : ‘হ্যাশ ট্যাগ মি টু’র আজকের লেখাটি ভারতের দিল্লীনিবাসী বাঙালি লেখিকা অধীসা সরকারের ফেসবুক পোস্ট থেকে নেয়া হয়েছে। তিনি লিখেছেন, #গবঃড়ড় হ্যাশট্যাগ দিয়ে একটা ক্যাম্পেন চলছে। যৌন হেনস্থার শিকার নারী-পুরুষ এই হ্যাশট্যাগের মাধ্যমে একে অপরকে জানাচ্ছেন তাঁরা একই নৌকোর যাত্রী। এবং অপরে বুঝছেন সমস্যার ম্যাগ্নিচ্যুড। আ্যওয়ারনেস তৈরী করার জন্য বেশ ভালো এই ক্যাম্পেন। যেমন আমার বন্ধুদের মধ্যে কিছু ছেলে যে মেয়েরা বলতে পারেনি তাদের হয়ে পোস্ট দিয়েছে যাতে যারা বলতে পারেনি তারা কোনোভাবে কর্নার্ড ফীল না করে, এবং সকলের চয়েসের জায়গা থাকে, সেরকমই আমার লিস্টের অন্তত একজন মানুষ দেখলাম সৎভাবে স্বীকার করেছেন তিনি একদা এ কাজ করেছেন, তিনি দুঃখিত। ‘কে করে এসব, আমরাই তো করি!’ তিনি বলেছেন। দেখলাম, কলকাতা পুলিশ এই ক্যাম্পেনকে সমর্থন করে পোস্ট দিয়েছে। এগুলো ভালো দিক।
অন্য দুর্গন্ধযুক্ত কিছু দিকও বেরিয়ে আসছে। এক মহিলা তার পোস্টে লিখেছে – ‘নট মি টু’। আমি জিন্দা লাশ নই।’ সে সাজেস্ট করতে চেয়েছে, যে নারীরা ‘মি টু’ লিখছে তারা ‘সিম্প্যাথি কুড়োচ্ছে’। ভিক্টিম মানেই নিকৃষ্ট। নিজেকে ওয়ান্ডার উইম্যান মনে করছেন, কারণ তিনি নাকী আইন পড়ে মোলেস্টারদের শাস্তি দিয়ে ক্ষান্ত হয়েছেন। ভাবতেই ভয় লাগে, যে আমাদের দেশে শিশুদের ওপর যৌনহেনস্থার অবস্থাটা দেশের আইন-পড়ুয়া লোকজন জানেই না। তাই তাবৎ ভিক্টিম কেন উলটে লড়তে পারেনি, সেই নিয়ে তাদের শেমিং করতে চায়। এও জানে না, যে আমাদের দেশে নীতিশিক্ষার কী হাল, মেয়েদের কী শিখিয়ে বড় করা হয়, তারা রেপ বা মোলেস্টেশন চিহ্নিত করতেই পারে না অনেক ক্ষেত্রে। অনেকক্ষেত্রে আইন হাতের নাগালেই থাকে না। তাদের সবাইকেকে শেমিং করছে একজন আইনজ্ঞ, ‘জিন্দা লাশ’ বলছে।
মানে, ধরে নিলাম এগুলো জানে না। নাহলে তো আত্মস্লাঘায় ডগোমগো মূর্খ না ভেবে তাকে অনেক খারাপ কিছু ভাবতে হয়। নামটা দিলাম না এনার, কারণ আমি অন্তত মূর্খামি করতে চাই না।
তবে সেখানেই শেষ নয়। সেই পোস্টে তপন চক্রবর্তী নাম্নী এক শুয়ারের বাচ্চা নিচের এই কথাগুলো বলেছে। পোস্টে প্রোফাইল লিংক দেওয়া থাকল। গেলে দেখবেন, সে ‘গব ঃড়ড়’ বলে একটা আ্যলবাম বানিয়েছে। তাতে একগুচ্ছ বলিউডি নায়িকার ভাইটাল স্ট্যাটসহ ছবি। প্রতিটা ছবিতে লেখা- ‘মি টু’। অনেকে পয়েন্ট মিস করে যান তাই বলে দিই, বলিউডি নায়িকাদের ভাইটাল স্ট্যাট নিয়ে আমার কোনো ছুৎমার্গ নেই। কিন্তু সেই আ্যলবামটার নাম ‘মি টু’’। যেটা একটা আ্যন্টি সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট ক্যাম্পেন। ধর্ষকের মানসিকতা চেনা যাচ্ছে তো?
এসব দেখেই মনে হয় না, এই এত মেয়ে বলছে, কারা এদের মলেস্ট করেছে? এই যে, চিনে নিন। মুখের ওপর সৎভাবে স্বীকার করতে তো সাহস লাগে, কিন্তু কেউ কেউ আবার ভুল করে জাত চিনিয়ে ফেলে। তপন চক্রবর্তী নামে এই লোক কয়েকজন মেয়ের ভাইটাল স্ট্যাটসহ ছবি পোস্ট করল। যেহেতু তাঁরা নায়িকা, ছবিটা পাব্লিক ডমেনে আছে আর স্ট্যাটটাও, তাই কিছু বলার নেই। কিন্তু সেই ছবিতে সে লিখল #সবঃড়ড়. ‘মি টু’ ক্যাম্পেনটা আ্যন্টি-সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট ক্যাম্পেন। যারা যৌন নিগ্রহের ভিক্টিম, তারা লিখেছে ‘মি টু’। এই লোক ওই ছবিগুলোয় ‘মি টু’ লিখে বোঝালো, এই মেয়েগুলো যৌন নিগ্রহের ‘ন্যাচারাল ভিক্টিম’। কেন? কারণ তারা কম জামাকাপড় পরে আছে। তাদের শরীরের মাপ সর্বজনবিদিত। এরকম জামাকাপড় পরলে তো মোলেস্টেড হবেই। এটাই বলতে চাওয়া হয়েছে। প্লাস, ভাইটাল স্ট্যাটসহ ছবি দিয়ে বলতে চাওয়া হয়েছে, এরা যৌন কমোডিটি। এদের ক্ষেত্রে মোলেস্টেশন একটা উপহাস। যেমন অনেককে বলতে শোনা যায়, ‘বেশ্যার আবার ধর্ষণ’!
ধরা যাক, ফর আর্গুমেন্ট’স সেক, আমরা ভুল বুঝেছি। তো, আমরা ক্ল্যারিফাই করতে গেলাম। তপন উত্তর দেয়, ‘সাধারণ মেয়েরাই যেখানে এত হেনস্থা হচ্ছে, স্বল্পবসনারা কত হবে, এই ভেবে করেছি’। এই আর্গুমেন্ট আসলে কী বলছে? স্বল্পবসনা হলে মেয়েরা আরো বেশী ধর্ষিত হয়। এটা প্রাথমিকভাবে মিথ্যে। সৌদি আরব ও পাকিস্তানে প্রচুর রেপ হয়, যেখানে প্রায় সব মেয়ে বোর্খা পরে। দ্বিতীয়ত, এটা অপরাধ। এটা ভিক্টিম ব্লেমিং। অর্থাৎ, রেপের দায় ভিক্টিমের ঘাড়ে ঠেলে দেওয়া হল। স্বল্প পোশাক পরলে রেপ তো হবেই। দিল্লি রেপ কেসে রেপিস্ট লোকটার ইন্টারভিউটা কী শুনেছিলেন কখনো? সেও ঠিক একই কথা বলেছিল। ‘মেয়েটা ছোট জামা পরে রাতে বাসে উঠেছিল তাই রেপ করেছি’। এই যুক্তি একজন রেপিস্টের যুক্তি।
লোকটা এও বলে, ‘অনেক মেয়ে মোলেস্টেড হতে ভালোবাসে’। এই কথাটা আরেকবার ভিক্টিম ব্লেমিং। মানে যাকে দেখে ‘মনে হচ্ছে’ মোলেস্টেড হতে চায়, তাকে মোলেস্ট করা যেতেই পারে। এবং কথাটা টোটালি ভিত্তিহীন। ইচ্ছাকৃত যৌনতার সাথে মোলেস্টেশনের কোনো যোগ নেই। মোলেস্টেশন, বাই ডেফিনিশন, ইচ্ছার বিরূদ্ধে যৌন নিগ্রহ। একটা মেয়ে (বা ছেলে) ইচ্ছা সহকারে যত ইচ্ছে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হতে পারে। তার অধিকার আছে। কিন্তু তার ইচ্ছের বিরূদ্ধে তার গায়ে হাত দেওয়া হলে সেটা একইরকমভাবে যৌন নিগ্রহ। ওটা যুক্তি নয়, মর্যাল পোলিসিং।
এই গ্রাউন্ডে আমরা তাকে ছবিগুলো ডিলিট করে ক্ষমা চাইতে বলি। কিন্তু সে সেটা করবে তো নাই, উলটে একই ধরনের আরো বিভিন্ন ইন্ধনমূলক পোস্ট করে চলেছে। এইধরনের লোক সমাজের পক্ষে ক্ষতিকারক। কারণ এর বন্ধু এবং ফলোয়াররা একে একজন মুক্তমনা বিপ্লবী সত্ত্বা হিসেবে চেনে। এর মুখোশ খুলে দেওয়া ভীষণ দরকার।
প্রসঙ্গত, গত ১৫ অক্টোবর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীদের প্রতি যৌন নিপীড়ণ ও হয়রানীর প্রতিবাদে ‘হ্যাশ ট্যাগ মি টু’ নামে একটি আন্দোলন শুরু হয়। বিশ্বের লাখ লাখ নারী এমনকি পুরুষরাও তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া যৌন হয়রানীর ঘটনা লিখে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।