বিচারপতি সিনহা ও কিছু কথা
রোহিঙ্গা সমস্যা, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি যে বিষয়টি দেশব্যাপী তো বটেই, সন্দেহ, কোনটি সত্য, কোনটি মিথ্যা তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনা সমালোচনার ঝড় যখন তুঙ্গে তখন মুখরোচক অনেক কথাই ইথারে ভেসে এসেছে। তবে বিপদে ছিল জনগণ এই ভেবে যে, প্রকৃতপক্ষে প্রধান বিচারপতি সিনহা কি সুস্থ, নাকি অসুস্থ? পদত্যাগ কি স্বেচ্ছায় না চাপের মুখে? ইতোমধ্যে বঙ্গভবনে আপিল বিভাগের বিচারপতিদের দাওয়াতের পরিমাণটিও বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ইতোপূর্বে লক্ষ্য করা যায়নি। অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিগণের বরাতে মিডিয়াতে পাল্টাপাল্টি বিবৃতি প্রদানের ঘটনা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইতোপূর্বে পরিলক্ষিত হয়নি। যদি একটু পিছনে ফিরে দেখি তবে দেখা যায় যে, সরকার ও আওয়ামী ঘরনাদের বক্তব্য মতে একজন ছিচকে উকিল, পাকিস্তান সমর্থিত শান্তি কমিটির সদস্য, একজন ঘুষখোরসহ নানা উপাদানে যাকে (সিনহা) ভূষিত করা হয়েছে তাকেই প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল সরকার যারা নিজেদের অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের একক প্রতীক হিসেবে মনে করে।
প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর মূর্তি বানিয়ে এক বিতর্কের জন্ম দিলেও বিচারবিভাগের স্বাধীনতার পক্ষে তার স্বোচ্ছার ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। তাছাড়াও আদালতের ঘুনেধরা প্রশাসনিক পদ্ধতিকে তিনি সংস্কার করার চেষ্টা করেছেন। মি. সিনহা নিজে যদিও আওয়ামী লীগার হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে বিন্দুমাত্র ছাড় দেননি, যার ফলশ্রুতিতে বিরোধী দলকে কোণঠাসা করেছেন। কিন্তু বিধিবাম হলো একটি রায়ের অবজারবেশনের কারণে। ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রপতি হিসেবে আসন অঙ্কন করায় ইঙ্গিত ভারতীয় পত্রপত্রিকায় ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছিল বটে; বর্তমানে দেশ পরিচালনায় ভারতীয়দের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। প্রধান বিচারপতির নিয়োগ সংক্রান্তে ভারতের ইচ্ছে-অনিচ্ছাকে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয় বলে অনেকেই মনে করছেন, যদিও কাগজে-কলমে দেওয়ার মতো এখানে কোনো প্রমাণ নেই। পক্ষান্তরে কাগজে-কলমে সব প্রমাণ থাকার কথা নয়, স্বাক্ষ্য আইনের বিধান মতে পারিপার্শ্বিক স্বাক্ষ্যই ক্ষেত্র বিশেষে যথেষ্ট।
পাঠকের যদি স্মরণে পড়ে, রায়ের পরেই প্রকাশ পেল যে, সিনহার বিরুদ্ধে ১২৬টি অভিযোগ দুদকে জমা পড়েছে, যা খতিয়ে দেখছে দুদক। দুদক চেয়ারম্যান রাজনৈতিক নেতার মতোই দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন যে, এ মর্মে দুদক স্বচ্ছ থাকবে। তবে রাষ্ট্রপতির হাতে ছিল ১১টি অভিযোগ যা থেকেই আপিল বিভাগের বিচারপতিগণ সিনহার সঙ্গে আপিল বিভাগের বেঞ্চে একত্রে না বসার জন্য প্রভান্বিত হয়েছেন, নাকি সত্য ও ন্যায়কে অবনত মস্তকে গ্রহণ করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন এ মর্মে জনগণের নিকট সেটার দালিলিক কোনো তথ্য নেই।
সরকারের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে ১৩ অক্টোবর ২০১৭ তারিখে রাত্রে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পূর্বে প্রধান বিচারপতি সিনহার বক্তব্য প্রশংসার দাবি রাখে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি সম্পূর্ণ সুস্থ। পালিয়ে যাচ্ছি না, দেশে অবশ্যই ফিরে আসব।’ সিনহার উক্ত বক্তব্য দেশবাসী ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব শুনেছে। সিনহার বক্তব্য যদি সত্য হয় তবে রাষ্ট্রপতির নিকট দাখিলকৃত ছুটির দরখাস্ত মিথ্যা। অন্যদিকে বঙ্গভবন ও সরকারের বক্তব্য সত্য হয় তবে প্রধান বিচারপতি মিথ্যা বলেছেন। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যদি ‘সত্য-মিথ্যা’ অর্থাৎ ‘চোর-পুলিশ’ (ছোট বেলায় চোর-পুলিশ খেলতাম, সেখানে একবার পুলিশ হিসেবে, অন্যবার চোর হিসেবে খেলেছি) খেলা হয় তবে অসহায় জনগণ আস্থার স্থানটি কোথায় পাবে?
স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিতে হবে যে, রাষ্ট্রপতি স্থির নিশ্চিত হয়েই ১১টি অভিযোগ আপিল বিভাগের বিচারপতিদের নিকট শুধু উপস্থাপন হয়নি বরং উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হয়েছে। অতএব, সামাজিক বিচার-আচারের মতো সিনহার বিচার আপিল বিভাগের বিচারপতিরা করে ফেলেছেন সিনহার সঙ্গে একত্রে না বসার ঘোষণা দিয়ে (গ্রাম্য সালিশেও এখনো ‘একঘরে’ রাখা হয়। যেখানে যাকে ‘একঘরে’ করে রাখা হয় তার সঙ্গে কেউ কোনো আচার-অনুষ্ঠানে যোগ দেয় না, কোনো সামাজিক/পারিবারিক যোগাযোগ রাখাকে অপরাধ মনে করেন)। কিন্তু আইনগত বিচার বা সাংবিধানিক পদ্ধতিতে বিচার কার্যক্রম শুরু হয়নি। এটাও নির্ভর করে প্রধানমন্ত্রীর ‘অভিমানের’ গভীরতার ওপরে!
ঘটনা অথবা প্রভাব যাই হোক বিদেশ থেকে পদত্যাগের মাধ্যমে আপোসহীন সিনহার, ‘আপোসহীনতার মৃত্যু ঘটেছে। তিনি নিরাপত্তা অথবা জেল হাজতের ভয়েই’ কি দেশে ফেরা তার সুদূরপরহত? (যে ভাষায় বলেছিলেন এ্যাটর্নি জেনারেল সে ভাষাতেই বলা হলো) তবে প্রধানমন্ত্রীর অভিমানে (সিনহার মতে) সিনহাকে যেমন দেশ ছাড়তে হয়েছে, অনুরূপ ‘পদত্যাগ’ প্রধানমন্ত্রীর অভিমানকে কতটুকু ধুয়ে মুছে ফেলেছে তারই ওপর নির্ভর করবে সাবেক প্রধান বিচারপতি সিনহার দেশে ফেরা না ফেরা। কিন্তু আলোচনার দ্বার এখানেই শেষ নয়। রাষ্ট্রীয় স্বার্থে জাতিকে আরও গভীরে যাওয়া দরকার, বিচারবিভাগের স্বাধীনতার হালকা না গভীর তা পরখ করার জন্য।
লেখক : কলামিস্ট ও বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা
ঃধরসঁৎধষধসশযধহফধশবৎ@মসধরষ.পড়স