আর একটি ১৪ ডিসেম্বর জাতি চায় না
মো. আলাউদ্দিন আল আজাদ : মনে আছে কী? ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরের কথা! এদেশিয় দোসরদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সোনার বাংলার হিরার টুকরো মানুষগুলোকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করার কথা! ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিক্ষক, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ; যারা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাকে বাস্তবরূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারেন; তাদের সবাইকে নির্মমভাবে খুন করা হয়েছিল! বুদ্ধিজীবী ভ্রাতা শহীদুল্লাহ্ কায়সার-কে খোঁজ করতে গিয়ে ৩০ জানুয়ারি ১৯৭২-এ নিখোঁজ হয়েছিলেন সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান। তিনি জীবিত না মৃত তা এদেশের মানুষ আজও জানে না, এখনো তার পরিবার জানে নি তাদের মানুষটা বেঁচে আছে না মরে গেছে! দিন যত যাচ্ছে কেন জানি মনে হচ্ছে ৭১ এর ১৪ ডিসেম্বর এখনো আসছে। আর কতক শিক্ষক, গবেষক, ছাত্র, সাংবাদিক, প্রকৌশলী, প্রকাশক, রাজনীতিবিদদের নিয়ে চলে যাচ্ছে! পরিবারের লোকজন হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর খবর জানতে পারছে না, জানছে না তাদের মানুষটা আদৌ বেঁচে আছে, না চিরতরে হারিয়ে গেছে! দেশ গড়ার সোনার মানুষগুলো হাওয়া হয়ে যাওয়া ঘটনার নতুন নাম ‘গুম’। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর মতে – ২০১০ সাল থেকে অক্টোবর ২০১৭ সালের মধ্যে ৫২৪ জন ব্যক্তি গুম হয়েছে, যাদের মধ্যে এখনও ৩৩৪ জনের কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি। আর শুধু এই বছরের ২২ আগস্ট থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত ১০ জন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ব্যক্তি নিখোঁজ হয়েছে। নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইশরাক আহমেদ ফাহিম, সাংবাদিক উৎপল দাস, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোবাশ্বার হাসান, প্রকাশক তানভীর ইয়াছিন করিম। ২২ আগস্ট ক্যান্টনমেন্ট থানাধীন বিমানবন্দর সড়ক থেকে অপহৃত হয় সৈয়দ সাদাত আহমেদ নামে এক রাজনীতিবিদ। ২৭ আগস্ট ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ কুমার রায়কে গুলশানের ইউনিয়ন ব্যাংকের সামনে থেকে কে বা কারা অপহরণ করে নিয়ে যায়। একই দিনে সাভারের আমিন বাজারের বাসা থেকে বের হয়ে ফিরে আসে নি রাজনীতিবিদ এম এম আমিনুর রহমান। ৭ নভেম্বর খিলগাঁওয়ের দক্ষিণ বনশ্রী এলাকা থেকে নিখোঁজ হয় নকিয়া-সিমেন্স প্রতিষ্ঠানের সাবেক প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান ও তার ছোট ভাই ফয়সাল রহমান।
চুরি, ডাকাতদেরতো গুম হতে শুনা যায় নি; আজকাল সাধারণ মানুষ গুম হচ্ছে! চুরি কিংবা ডাকাতির অভিযোগে গ্রেফতারের সময় বা পরে চোর-ডাকাতদের স্বজনেরা অন্তত নির্ভার থাকে এই ভেবে যে – তাদের ছেলে বেঁচে আছে, নিরাপদে আছে। আজকাল বাসা ও রাস্তা-ঘাট থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সাধারণ নাগরিকদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। যদিও কর্তৃপক্ষ ঐসব সদস্যদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ নয় বলে দাবি করে। কারা প্রকৃত আইনের সদস্য তা নির্ণয়ের ক্ষমতা সাধারণ মানুষেরা রাখে না কিংবা এটা তাদের কাজও নয়; তারা শুধু শুনেছে বা আইনের সদস্য পরিচয়ে আপনজনকে গ্রেফতার করে নিয়ে যেতে দেখেছে! পরে খোঁজ নিতে থানায় গেলে আপনজনের হদিস পায় নি।
সাধারণ নাগরিকদের পিছু ছাড়ছে না ‘গুম আতঙ্ক’। কে, কখন, কোথায়, কীভাবে গুম হবে তার ঠিক নেই। সাধারণ নাগরিকরা তবুও হতাশ হয় না; ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীন দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে, নিরাপদ থাকার অঙ্গীকার নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখে! তারা শতভাগ আস্থা রাখে তাদের ওপর, যারা স্ত্রী-সন্তানের মায়াকে গৌণ করে দিয়ে নাগরিকদের সার্বিক নিরাপত্তা বজায় রাখা ও দেশের শৃঙ্খলা বজায় রাখার পণ্যকে মুখ্য এবং মূল কাজ ভাবে; অনেকগুলো রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দেয় সাধারণ মানুষগুলোকে শঙ্কামুক্ত রাখতে। এবং তারা অতীতে পেরেছে, বর্তমানেও সফল হবেই বলে এদেশের প্রতিটি মানুষ বিশ্বাস করে।
আমার দেশে আইনের সদস্য পরিচয় দিয়ে যে বা যারা গুমের ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে তাদের চিহ্নিত করতে হবে, বিচার নিশ্চিত করতে হবে। কোনো অশুভ গোষ্ঠীর জন্য জন-মানুষের অতন্দ্র সেবক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কলঙ্কিত করবার যুৎসই জবাব দিতে হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ